এই মেয়েকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল! আজ তিনি কোথায়!

সংসারে দুটো বাড়তি টাকা আনতে হাতের কাজ শিখতে যেতেন ফুলকলি হাজরা। কিন্তু ঘরের বউয়ের এমন বাইরে বেরোন মোটেই পছন্দ করেননি বাড়ির প্রবীণারা। সন্দেহ থেকে অশান্তি, শেষ অবধি গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল তরুণী বধূকে।

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৮:১৫
Share:

সংসারে দুটো বাড়তি টাকা আনতে হাতের কাজ শিখতে যেতেন ফুলকলি হাজরা। কিন্তু ঘরের বউয়ের এমন বাইরে বেরোন মোটেই পছন্দ করেননি বাড়ির প্রবীণারা। সন্দেহ থেকে অশান্তি, শেষ অবধি গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল তরুণী বধূকে। পড়শিদের সাহায্যে সে ফুলকলি যাত্রায় রক্ষা পান আগুন থেকে।

Advertisement

সে দিন যাঁরা নিগ্রহ করেছিল, শ্বশুরবাড়ির তেমন অনেকে আজ ফুলকলিদেবীর কাছে হাতের কাজ শিখতে আসেন। রানিনগর-১ ব্লকের ইসলামপুরের হাজরাপাড়ায় নিজের আয়ের টাকায় দোতলা বাড়ি তৈরি করেছেন ফুলকলি। নিজের তৈরি পথে চলতে শিখিয়েছেন অন্য মেয়েদেরও। গড়ে তুলেছেন ‘অগ্রগামী মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী’। ইসলামপুর চক পঞ্চায়েত এলাকার পাঁচশোরও বেশি মহিলা তাঁর অধীনে কাজ করেন। ‘‘ওই মেয়েদের বাড়িতে পাট পৌঁছে দিয়ে আসি। মাসের শেষে হিসেব করে দেখা যায়, ৩৫০০ টাকা থেকে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন এক একজন,’’ বললেন ফুলকলি।

সাড়ে তিন-চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করে, এখন কয়েক লক্ষ টাকার ব্যবসা ফুলকলির। যিনি বাড়ির বাইরে পা রাখার জন্য মার খেয়েছিল, তিনিই কলকাতা, মালদহ, বহরমপুর, বাঁকুড়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পঞ্জাব, দিল্লি, ওডিশা, মুম্বইয়ের হস্তশিল্প মেলাতেও যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যের বাইরে আমাদের হাতের কাজের কত চাহিদা রয়েছে। মেলায় আসা মানুষ শিল্পী হিসেবে কত সম্মান দিত আমাদের। ওই সম্মান বাড়িতেও কেউ কোনও দিন দেয়নি।’’ ‘মাস্টার টেলার’ হিসেবে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে জেলা শিল্পকেন্দ্র দফতরও তাঁকে রাজ্যের নানা জায়গায় পাঠায়।

Advertisement

বেলডাঙা-২ ব্লকের আন্দুলবেড়িয়া গ্রামের মেয়ে ফুলকলি। বয়স যখন ১৪, তখন রানিননগর-১ ব্লকের পেশায় রাজমিস্ত্রী বিকাশ হাজরার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের আগে বাবা-মায়ের সংসারের অভাব ছিল। বিয়ের পরে স্বামীর ঘরে এসেও দেখেন অভাব। দুই মেয়ে হওয়ার পর খরচ বাড়ল। বাড়তি রোজগারের আশায় ২০০২ সালে স্থানীয় এক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে হাতে-কলমে কাজ শিখতে শুরু করেন। পাট থেকে খেলনা, ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরির হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল ব্লক প্রশাসন। সেখান থেকে দু’মাসের প্রশিক্ষণ নেন। ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিজের মায়ের কাছে রেখে বহরমপুরের বানজেটিয়ার এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ১২ দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণ নেন ফুলকলি। তারপর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ডাক আসতে থাকে নানা মেলা থেকে। ভাল চাহিদা তৈরি হয় তাঁর হাতের তৈরি জিনিসের।

নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দারিদ্রের অসম্মানকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন ফুলকলি। ‘‘বাবা-মা ফোন করে খোঁজ নেবে বলে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতাম। অনেক সময়ে ফোন করলেও তারা ডেকে দিত না। এখন আমার বাড়িতে চারটে মোবাইল ফোন,’’ বলেন তিনি। তবে নিজের প্রথম আয়ের টাকায় কেনা ১৪-ইঞ্চি রঙিন টিভি ফেলতে পারেননি। ‘‘চাইলে ৪২ ইঞ্চি রঙিন টিভি কিনতে পারি। কিন্তু নিজের আয়ের টাকায় প্রথম কেনা বলে মায়া পড়ে গিয়েছে পুরনো টিভিতে,’’ বললেন তিনি।

স্বামী বিকাশবাবু তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘‘বহু লোক বহু কিছু বলেছে। সারাক্ষণ কানের কাছে আজেবাজে কথা শুনে কখনও কখনও আমিও মাথা গরম করে ফেলেছি। পরে ভুল বুঝেছি।’’ তবে স্ত্রী-র জেদ ও নিষ্ঠার প্রতি বরাবরই ভরসা ছিল তাঁর, জানান বিকাশবাবু। ফুলকলিও জানালেন, মেলায় যাওয়ার কথা থাকলে তাঁর স্বামী এখন সারা দিনের পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে পাটের তৈরি সামগ্রী বাক্সবন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাইকেলে করে বাসেও তুলে দিয়ে আসেন। কখনও ভ্যান রিকশা ঠেলে নিয়ে যান। ‘‘নানা জায়গায় আমাকে ছুটে বেড়াতে হয়। ঠিক মতো রান্নাও করতে পারি না। কিন্তু কোনও ঝামেলা হয় না। ১৫-২০ দিনের জন্য মেলায় চলে গেলে ও নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়। মেয়েদেরও খেতে দেয়,’’ বলছেন ফুলকলি।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় স্কুলের পড়াশোনা করতে পারেননি ফুলকলি। সেই অপূর্ণ ইচ্ছে মেয়েদের মধ্যে দিয়ে পূরণ করতে চান। ফুলকলিদেবী জানান, ‘‘স্বাবলম্বী না হলে সমাজে মেয়েদের কোনও জায়গা নেই। পড়াশোনা করে মেয়েরা চাকরি করছে, দেখতে চাই। তার পরেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন