বারাসত বিদ্যাসাগর ভবনের একটি সভায় গৌতম দেব। ছবি: সুদীপ ঘোষ
তৃণমূল ছেড়ে মুকুল রায়ের নতুন ইনিংসের সম্ভাবনা নিয়ে চর্চা এখন জোরদার। সেই মোক্ষম মুহূর্তে তাঁর দিকে হাত বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। জোরদার করার চেষ্টা করলেন তৃণমূল-বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টাকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতাচ্যুত করাই যে তাঁদের প্রধান লক্ষ্য, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বারবারই সে কথা বলছেন গৌতমবাবু। সেই লক্ষ্যেই আগামী বিধানসভা ভোটে বিজেপি এবং তৃণমূল-বিরোধী মঞ্চ গড়ে এগোনোর কথাও বলছেন তিনি। এ বার সেই মঞ্চের জন্যই প্রয়োজনে মুকুলের সঙ্গে আলোচনার কথাও উড়িয়ে দিলেন না গৌতমবাবু। বারাসতে মঙ্গলবার উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের উদ্যোগে একটি সংখ্যালঘু কনভেনশনের আয়োজন হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, মুকুলও এখন চেষ্টা চালাচ্ছেন সংখ্যালঘু ভাবাবেগকে স্পর্শ করে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে ধাক্কা দিতে। কনভেনশনের শেষে এ দিন গৌতমবাবুর কাছে প্রশ্ন ছিল, তাঁদের তৃণমূল ও বিজেপি-বিরোধী মঞ্চে মুকুল তাঁর নতুন দল নিয়ে কি আসতে পারেন? সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক তার উত্তরে বলেছেন, ‘‘মুকুল রায় যদি আসতে চায় আসুক। কথা বলুক! রাজনীতিতে ‘না’ বলে কোনও কথা আছে নাকি?’’
স্বভাবতই গৌতমবাবুর মুখে এমন মন্তব্য আলোড়ন তৈরি করে দিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে! বিশেষত, মন্তব্যকারীর নাম যে হেতু গৌতম দেব, তাই আলোড়ন আরও বেশি! গত বিধানসভা ভোটের আগে গৌতমবাবুই প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রকাশ্যে এনেছিলেন তৃণমূলে মুকুলের নেতৃত্বে কুপন কেলেঙ্কারির অভিযোগের কথা। যার জেরে তাঁর বিরুদ্ধে মুকুলের দায়ের করা মানহানির মামলা এখনও আদালতের বিচারাধীন। তার পরেও একাধিক বার ডেলোর বৈঠক বা অন্য প্রসঙ্গে মুকুলকে নিশানা করে গিয়েছেন গৌতমবাবু। এমনকী, দিনদশেক আগে ওই বারাসতেই সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের সমঝোতার সম্ভাবনা উস্কে দিতে গিয়েও বলেছিলেন, ‘‘কে মুকুল? সে তো ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে!’’ এখন তাঁর মুখেই মুকুলের জন্য ‘না’ নেই শুনে নড়েচড়ে বসছে সব মহলই।
বস্তুত, বাম ও তৃণমূল দুই শিবিরেরই একাংশের ব্যাখ্যা, কৌশলগত ভাবেই ওই মন্তব্য করেছেন গৌতমবাবু। যাতে তাঁর পুরনো রেকর্ড মাথায় রেখে কেউ কেউ একে নিছকই ‘কথার কথা’ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। আবার সেই অবসরে মমতা-বিরোধী মঞ্চের চর্চা জিইয়ে থাকে! অন্য পক্ষের আবার ব্যাখ্যা, গৌতমবাবু বুঝিয়ে দিলেন, রাজনীতি সম্ভাবনারই শিল্প। সেখানে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়!
সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের তরফে কেউ এ দিন গৌতমবাবুর মন্তব্য প্রসঙ্গে মুখ খোলেননি। তবে দলের এক রাজ্য নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘মুকুলের নতুন দল গড়া মানে অবধারিত ভাবে তৃণমূলে ভাঙন। গৌতম সম্ভবত সে দিকে নজর রেখেই কিছু বলতে চেয়েছেন।’’ মুখ খোলেননি স্বয়ং মুকুলও। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে অবশ্য বলা হয়েছে, মুকুলের মঞ্চ যে রাজ্য রাজনীতিতে দাগ কাটতে পারে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তাঁদের সেই ‘মান্যতা’ দিয়ে রাখলেন গৌতমবাবু। মুকুলের ইফতার পার্টিতে যোগ দেওয়ায় সোমবারই তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই বিধায়ক শিউলি সাহা ও শীলভদ্র দত্তকে সাসপেন্ড করেছে তৃণমূল। যে ঘটনাকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ভয় পাওয়ার লক্ষণ হিসেবেই দেখছে মুকুল-শিবির। এ দিন গৌতমবাবুর মন্তব্য তাদের আরও সাহস জুগিয়েছে।
ঘটনা হল, প্রকাশ্যে যা-ই বলা হোক, সিপিএমের বড় অংশও মুকুলের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে। মুকুলেরা যদি সত্যিই ‘তৃণমূল’ নাম নিয়ে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারেন এবং নতুন দল গড়ে তৃণমূলের কিছু নেতাকে টেনে আনতে পারেন, তা হলে তাঁরা ভাঙন ধরাবেন মমতার ভোটব্যাঙ্কেই। সে দিকে নজর রেখেই কৌশলে সব সম্ভাবনা খোলা রাখছেন গৌতমবাবুরা। মুকুলের ইফতারে যাওয়ার পরে তৃণমূলের দুই বিধায়কের সাসপেনশন প্রসঙ্গে এ দিন গৌতমবাবু বলেওছেন, ‘‘আরও লোক বার হবে। অনেক বিধায়ক বেরিয়ে যাবে! দেখুন না কী হয়!’’
গত লোকসভা এবং কয়েকটি উপনির্বাচনে বামেদের ভোটে ভাগ বসিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু পুরভোট থেকে চাকা আবার অন্য দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। বিজেপি নয়, এ রাজ্যে তৃণমূলকে রোখার কৌশল নিয়েই যে তাঁরা বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন, তা-ও বুঝিয়েছেন গৌতমবাবু। বলেছেন, ‘‘বিজেপি আমাদের থেকে ১৩% ভোট ধার নিয়েছিল। সেটাও এ বার নিয়ে নেব!’’ আর সরাসরি কংগ্রেস-প্রশ্নে সওয়াল না করেও সব দরজা খোলা রেখেছেন। বুঝিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিপদ রুখতে প্রথম ইউপিএ-কে বামেরা চার বছর সমর্থন করেছিল।
তৃণমূল-বিরোধী জোটের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টা নিয়ে মুখ খুলছেন না কেউই। তবে কিছু দলের নেতৃত্ব একান্তে বার্তা বিনিময় চালাচ্ছেন বলেই খবর।