আমার টাকাটার কী হল, একটু দেখবেন স্যার

আমজনতার ক্ষোভ-বিক্ষোভের উত্তাপ থেকে তাঁকে বরাবরই আড়াল করে রেখেছে সশস্ত্র বাউন্সারদের ঘেরাটোপ। এত দিনে সেই অজানা স্বাদ পেলেন গৌতম কুণ্ডু। রোজভ্যালি-র একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্ণধার। বুধবার তখন প্রায় সন্ধে সাড়ে সাতটা। বিচারক জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পরে আদালত থেকে সবে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে এসে পৌঁছেছেন গৌতমবাবু। জেল কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫০
Share:

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

আমজনতার ক্ষোভ-বিক্ষোভের উত্তাপ থেকে তাঁকে বরাবরই আড়াল করে রেখেছে সশস্ত্র বাউন্সারদের ঘেরাটোপ। এত দিনে সেই অজানা স্বাদ পেলেন গৌতম কুণ্ডু। রোজভ্যালি-র একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্ণধার।

Advertisement

বুধবার তখন প্রায় সন্ধে সাড়ে সাতটা। বিচারক জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পরে আদালত থেকে সবে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে এসে পৌঁছেছেন গৌতমবাবু। জেল কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তৎপরতার সঙ্গে যাবতীয় লেখাজোখা মিটিয়ে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই নির্দিষ্ট সেলে চালান করা হয় ভিআইপি অতিথিকে। রোজভ্যালি-কর্তার বর্তমান ঠিকানা ‘মনীষী ওয়ার্ডে’র অরবিন্দ সেল। এর পরেই আচমকা মোড় ঘুরল চিত্রনাট্যে।

কৌতূহলীদের জটলা ঠেলে ছিপছিপে বেঁটেখাটো গৌতমবাবুর একেবারে গায়ের কাছে চলে আসেন বিচারাধীন বন্দি সন্তোষ পাঠক। জোড় হাতে বলতে শুরু করেন, ‘আমার জমা রাখা টাকার কী হল, একটু দেখবেন স্যার!’ জেল সূত্রের খবর, সন্তোষের দাবি, পাঁচ বছর আগেই রোজভ্যালিতে ৫৫ হাজার টাকা রেখেছিলেন তিনি। গত বছর সেপ্টেম্বরে তা দেড় লক্ষ টাকা হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের মেয়াদ ফুরোলেও ছিটেফোঁটা ফেরত আসেনি। এর মধ্যে খুচরো ঝামেলায় জড়িয়ে খিদিরপুরের সন্তোষের গতি হয়েছে জেলের অন্দরে। কিন্তু জেলে এসে সংস্থার মালিককেই যে সামনাসামনি নালিশ করার সুযোগ মিলবে, ভাবেননি সন্তোষ।

Advertisement

দেখা যায়, সন্তোষের মতোই উত্তেজিত ভঙ্গি ছোটখাটো কুকর্ম করে ধরা পড়া বসিরহাটের শেখ সাইদুল বা হেস্টিংস এলাকার বাসিন্দা মঞ্জি চৌধুরীরও। গৌতমবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাঁরাও নিজেদের সঞ্চয়ের সাতকাহন শোনাতে ব্যস্ত। সাইদুল আগে বেশ কয়েক বার নিজের খোয়ানো টাকার খোঁজে রোজভ্যালির অফিসে গিয়ে হত্যে দিয়েছেন। গলাধাক্কা ছাড়া আর কিছু জোটেনি। খোদ কর্ণধারের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাবটা এমন যেন কোনও ‘হটলাইন’-সংযোগ পেয়ে গিয়েছেন। সাইদুল চার বছর আগে এক লক্ষ টাকা রেখেছিলেন। সেটা এত দিনে তিন-চার লক্ষ হওয়ার কথা। গৌতমবাবুর উদ্দেশে তাঁর নাছোড় আবদার। ‘স্যার, পরশু ঘরের লোক আসবে! আমি কিন্তু এখনই খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, রসিদ সঙ্গে আনবে। এ বার আমার টাকাটারএকটা ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতেই হবে, স্যার।’

হেস্টিংসের মঞ্জি আবার শুধু নিজের কথা বলেই ক্ষান্ত নন। এক সঙ্গে গোটা পা়ড়ার হয়ে সওয়াল করে বসলেন। তাঁর দাবি, পাড়ার ১০-১২টা পরিবার তিন বছর আগেই ৪০ হাজার টাকা করে গৌতমবাবুর কোম্পানিতে জমা রাখেন। অন্তত লাখ টাকা পাওয়ার ছিল। এখনও কানাকড়ি জোটেনি। মঞ্জি নাগা়ড়ে সুর করে বলতে থাকেন, ‘তবে ওদের কাগজগুলো পাঠিয়ে দিতে বলি, স্যার! মামলার অনেক খরচ। টাকাটা এখন বড্ড দরকার।’

এ যাবৎ বিনিয়োগকারীদের আবেদন-নিবেদন নিজের কানে শুনতে হয়নি গৌতমবাবুকে। তাঁর দক্ষ ম্যানেজার ও এজেন্ট-বাহিনী মসৃণ ভাবে সবটা সামাল দিতেন। গৌতমবাবুর আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর পেল্লায় বিদেশি গাড়ির জানলায় বাইরের আঁচ এসে লাগেনি। শ্রীঘরে ঢুকেই এমন অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অসহায় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এ দিক-ও দিক তাকিয়ে বার কয়েক জেলকর্তাদের খোঁজার চেষ্টা করেন। এর পর অবশ্য নিজেই অবস্থাটা সামলে নেন। পকেটে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। চুপচাপ সবার কথা শোনেন। অন্য কয়েক জন বন্দি এগিয়ে এসে আবেদনকারীদের নিরস্ত করেন। তাঁরাই বোঝান, ‘দাদা, সবে এসেছেন, একটু জিরোতে দে!’

তবে সূচনার এই অস্বস্তিটুকু বাদ দিলে অবশ্য খোশমেজাজেই আছেন গৌতমবাবু। সঙ্গে করে আনা কেকের টুকরোয় নৈশাহারের পরে মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে জল খান। সকালে জেলের জল-মুড়িতে হাল্কা প্রাতরাশের পরে দুপুরে বাড়ি থেকে আসা খাবার খান। মাঝে জেল হাসপাতালে চেক-আপ, জেল-অফিসে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের ফাঁকে এক পুরনো পরিচিতের সঙ্গে দেখা করতে ভোলেননি। জেলের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে সারদা-কাণ্ডে ধৃত সাংসদ কুণাল ঘোষের সঙ্গে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলেন গৌতমবাবু। কুণালের পাশেই থাকেন সারদা মামলায় তাঁর সহ-অভিযুক্ত অসমের গায়ক সদানন্দ গগৈ। গৌতমবাবুর সঙ্গে হাত মেলান সদানন্দবাবু।

এই রোজনামচার মধ্যে ছন্দপতন বলতে ওই ‘আম-দরবার’। সেলে গৌতমবাবুর সঙ্গে জনা তিরিশ বন্দি রয়েছেন। অন্য বন্দিদের মধ্যেও তাঁর সংস্থার বিনিয়োগকারী রয়েছেন। জেলকর্তাদের অবশ্য দাবি, গৌতমবাবুর বিপদের ঝুঁকি নেই। তাঁর সুরক্ষায় যথেষ্ট খেয়াল রাখা হচ্ছে। রোজভ্যালি-কর্তার যত্ন তথা খিদমত খাটার জন্য বুবাই নামে এক বিচারাধীন বন্দিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন