ভোটের তাড়ায় এগিয়ে আসছে মেলা-খয়রাতির বার্ষিক পার্বণ

বিধানসভা ভোটের জন্য ময়দানে নামার আগে মেলা-খেলা-খয়রাতির বচ্ছরকার পালা শেষ করে ফেলতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে নির্দেশ পেয়ে তাঁর প্রশাসন ইতিমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে সরকারের নানা পার্বণের দিনক্ষণ এগিয়ে আনার তোড়জোড়।

Advertisement

অত্রি মিত্র ও সোমনাথ চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০৩
Share:

বিধানসভা ভোটের জন্য ময়দানে নামার আগে মেলা-খেলা-খয়রাতির বচ্ছরকার পালা শেষ করে ফেলতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে নির্দেশ পেয়ে তাঁর প্রশাসন ইতিমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে সরকারের নানা পার্বণের দিনক্ষণ এগিয়ে আনার তোড়জোড়।

Advertisement

যত দূর সম্ভব, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনপর্ব শুরু হয়ে যাবে আগামী বছরের এপ্রিলে। সে ক্ষেত্রে পুজোর পরেই প্রস্তুতির ঢাকে কাঠি পড়ে যাওয়ার কথা। এই সম্ভাব্য নির্ঘণ্ট মাথায় রেখে নবান্ন চাইছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উৎসব-খয়রাতির সিংহভাগ চুকিয়ে ফেলতে। যে তালিকায় অগ্রগণ্য মাটি উৎসব, টেলি-সম্মান, ক্লাব-অনুদান, সঙ্গীতমেলা ইত্যাদি।

নিজের সরকারের কাজের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বারবারই এই বলে আক্ষেপ করে থাকেন যে, বাম আমলে নেওয়া ঋণের সুদ গুনতেই কোষাগার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, ফলে ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা উন্নয়নের বহু কাজ করে উঠতে পারছেন না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এ হেন ‘টানাটানি’র সংসারেও মেলা-খেলা-উৎসব আয়োজনে সরকারের কার্পণ্য নেই! বরং তার বহর ও সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে প্রতিটি অনুষ্ঠানে বরাদ্দের পরিমাণও!

Advertisement

এই তালিকাতেই সর্বশেষ সংযোজন ‘আহারে বাংলা।’ প্রায় সওয়া দু’কোটি টাকা বাজেটের চার দিনব্যাপী উৎসবটি শুরু হবে আগামী ৩০ অক্টোবর, মিলনমেলা প্রাঙ্গণে। মেলার পাশাপাশি ফি সন্ধ্যায় সেখানে উপরি পাওনা ঢালাও নাচ-গানের আসর।

আর ভোটের তাড়ায় এ বছর দীপাবলি পেরোলেই শুরু হয়ে যাচ্ছে উৎসব-খয়রাতির ভরপুর মরসুম! কী রকম?

নবান্নের খবর: ক্লাবে ক্লাবে অনুদান দেওয়ার পালাটা এ বার জানুয়ারির বদলে আগামী নভেম্বরেই সেরে ফেলতে চায় সরকার। কোষাগারের টাকায় খয়রাতির এই অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল মমতা সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছর বাদে, ২০১২-র জানুয়ারিতে। সে বার ৭৮১টি ক্লাবকে ঢালাও অনুদান দিতে সরকারের খরচ হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। ২০১৩-য় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ কোটি। ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে অনুদান-তালিকায় ঢোকে দু’হাজার ক্লাব। এতে খরচের বহর দাঁড়ায় ৬৪ কোটির কিছু বেশি। আর ২০১৫-র জানুয়ারিতে তা ১২০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে, কারণ সরকারের আর্থিক দাক্ষিণ্য পেয়েছে নয় নয় করে চার হাজার ক্লাব!

এমতাবস্থায় ভোটের কথা মাথায় রেখে চলতি বছরে ফের ক্লাবগুলোকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। প্রাপক-তালিকার দৈর্ঘ বৃদ্ধিরও প্রভূত সম্ভাবনা। ক্রীড়া দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘এ বছর অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবের সংখ্যা বাড়বে। সংখ্যাটা ঠিক কত হবে, এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’’ তবে এই খাতে খরচ দু’শো কোটির কাছাকাছি পৌঁছতে পারে বলে প্রশাসনের একাংশের অনুমান।

এগিয়ে আসছে টেলি-সম্মান, যাত্রা উৎসব, সঙ্গীতমেলা ইত্যাদি। বাম আমলে সঙ্গীতমেলা হতো এপ্রিলে। তৃণমূল জমানায় তা এগিয়ে আসে জানুয়ারিতে। এ বার তা আরও এগিয়ে ডিসেম্বরের ২১ তারিখের মধ্যে শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মাটি উৎসব হবে ফেব্রুয়ারির বদলে জানুয়ারির প্রথমে। টেলি-সম্মান ও যাত্রা উৎসব শেষ হবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে।

তবে পিছিয়ে যাচ্ছে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। সাধারণত আন্তর্জাতিক উৎসবের সূচি পরিবর্তন করা যায় না। সেই মতো কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব হয় পূর্বনির্ধারিত দিনে— ১০ থেকে ১৭ নভেম্বর। কিন্তু এ বার দীপাবলির জন্য তা করা হচ্ছে ১৪ থেকে ২১ নভেম্বর। এর আগে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার মেয়াদও রীতিবিরুদ্ধ ভাবে বাড়িয়েছিলেন মমতা। সরকারের এই দেদার বেহিসেবি খরচ, আর তা সামাল দিতে গিয়ে ফি মাসে ধার করার সংস্কৃতি সম্পর্কেও নানা মহলে সমালোচনা কম হয়নি। এমনকী, প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (পিএজি)-এর অফিস নবান্নকে হুঁশিয়ার করেছিল, বাজেট বরাদ্দের মাত্র ২৭% পরিকল্পনা খাতে রেখেছে রাজ্য। উপরন্তু মেলা-খেলা-উত্‌সব-পুরস্কার, ইমাম-মোয়াজ্জিন ভাতা, সৌন্দর্যায়ন, নীল-সাদা রং বা হাজার হাজার ক্লাবকে টাকা বিলোতে বিস্তর টাকা বেরোচ্ছে। এতে রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি কোনও লাভই হবে না বলে পিএজি জানিয়েছে। বিধানসভা ভোটের আগে তড়িঘড়ি সরকারি মেলা-খেলা-উৎসব সেরে ফেলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে বিরোধীরাও। সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘রাজ্যে উন্নয়নের কাজ শিকেয়। সরকারি কর্মচারীরা এখনও পুজোর বোনাস পাননি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সে সবে ভ্রূক্ষেপ নেই! তিনি খয়রাতি করে ভোট কিনতে ব্যস্ত।’’ বিজেপি র শমীক ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সরকারটাই তো মেলা-খেলা-মোচ্ছবের সরকার! উন্নয়নের উপরে সরকারের আস্থা নেই। থাকলে তারা খয়রাতির রাস্তা ছেড়ে সরাসরি মানুষের সামনে দাঁড়ানোর সাহস দেখাত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন