‘সরকারের লোকের’ গায়ে হাত ! বিব্রত টিএমসিপি

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য পদে যোগ দেওয়ার দিন তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি সরকারের লোক।’ মঙ্গলবার বড়িশা বিবেকানন্দ কলেজে সেই ‘সরকারের লোক’ই নিগৃহীত হয়েছেন। এবং সুগত মারজিতকে নিগ্রহের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে শাসক দলেরই ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের উপরে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৩৯
Share:

নিজস্ব চিত্র

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য পদে যোগ দেওয়ার দিন তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি সরকারের লোক।’ মঙ্গলবার বড়িশা বিবেকানন্দ কলেজে সেই ‘সরকারের লোক’ই নিগৃহীত হয়েছেন। এবং সুগত মারজিতকে নিগ্রহের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে শাসক দলেরই ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের উপরে।

Advertisement

মঙ্গলবার বিক্ষোভকারী ছাত্রীরা কোনও দলীয় বা সংগঠনের পতাকা সঙ্গে আনেননি। কিন্তু যে দুই ছাত্রী মারমুখী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা টিএমসিপি-র পদাধিকারী বলেই খবর। তাঁরা বিবেকানন্দ কলেজের ছাত্রীও নন। ওঁরা গিয়েছিলেন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের একটি কলেজ থেকে।

যে ছাত্রীকে উপাচার্যকে ধাক্কা দিতে দেখা গিয়েছে, এ দিন সংবাদমাধ্যমে তাঁর ছবি দেখে টিএমসিপি নেতারা আঁতকে উঠেছেন। দক্ষিণ কলকাতার এক টিএমসিপি-র এক নেতার মন্তব্য, ‘‘এ তো দেশবন্ধু কলেজের টিএমসিপি-র ইউনিয়নের সহকারী সাধারণ সম্পাদক টিঙ্কু দাস। আর টিঙ্কুর পাশেই দেশবন্ধু কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদা খাতুন!’’

Advertisement

বিক্ষোভ যে একটু লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে, তা এখন বুঝতে পারছেন টিএমসিপি-র ওই দুই নেত্রীও। এদিন কলেজ যাননি কেউই। দিনের বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ রেখেছেন ফোন।

তার মধ্যেই বারবার ফোন কেটে দেওয়ার পরে এক বার কোনও মতে মোবাইলে ধরা গিয়েছিল টিঙ্কুকে। ফোন ধরে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা তো সবই জানেন। লিখে দিন।’’ উপাচার্যকে কেন নিগ্রহ করলেন কেন? টিঙ্কুর জবাব, ‘‘আমি এখন খাচ্ছি। আধ ঘণ্টা পরে কথা বলব।’’ এর পরে ফোন সুইচড অফ করে দেন টিঙ্কু। ওয়াহিদা এবং টিঙ্কু দু’জনকেই তাঁদের বাড়িতে পাওয়া যায়নি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো করে মঙ্গলবারের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছেন। বড়িশার ওই কলেজের অধ্যক্ষা সোমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার কলেজে শিক্ষিকাদের বিশেষ বৈঠক ডেকেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সহ বিক্ষোভরত ছাত্রীদের নাম, রোল নম্বর চেয়ে পাঠিয়েছেন। আমরা সেটা পাঠিয়ে দেব।’’ উপাচার্য সুগত মারজিত মনে করেন তাঁর উপস্থিতিই মঙ্গলবারের বিক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে। সুগতবাবু এ দিন বলেন, ‘‘আমার উপস্থিতি খানিকটা কারণ তো বটেই। আগে থেকে পরিকল্পনা করেই এটা করা হয়েছে।’’

অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার দাবি নিয়ে মঙ্গলবার চড়াও হয় একদল ছাত্রী। কলেজে ভূগোল বিভাগের সমাবর্তন চলাকালীনই অধ্যক্ষার ঘরে ঢুকে অভব্য আচরণ করতে থাকেন তাঁরা। সমাবর্তনে যোগ দিয়ে ফেরার পথে উপাচার্যের গাড়িও আটকান ওই পড়ুয়ারা। গাড়ি থেকে নেমে পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে উপাচার্যকে ধাক্কা মারেন এক ছাত্রী। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে অটো করে কলেজ থেকে বেরিয়ে যেতে হয় উপাচার্যকে। ঘটনাস্থলে তিনি বহিরাগত ছাত্রদেরও দেখেছেন বলে জানিয়ে সুগতবাবুর মন্তব্য, ‘‘মঙ্গলবার আমার গাড়ি প্রথম যে আটকায় সে একটি ছেলে। মেয়েদের কলেজে ছেলে কী করছিল? আমার মনে হয়েছে বিষয়টা শুধু কলেজেই আটকে নেই, বহিরাগত কিছু জনের ইন্ধন রয়েছে।’’ ‘সরকারের লোক’ সুগতবাবুর আক্ষেপ, ‘‘এটা বস্তুত একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা সারা পশ্চিমবঙ্গেই ছড়িয়ে গিয়েছে। বাদ পড়ছে না শিক্ষাক্ষেত্রও, এটা খুবই দুঃখের।’’

বিবেকানন্দ কলেজের পাশেই ডায়মন্ডহারবার রোড। ওই রাস্তার পশ্চিম দিকটাই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিধানসভা কেন্দ্র। পার্থবাবু অবশ্য আক্রমণকেই রক্ষণের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘এমন দুর্দশা আসেনি যে সংগঠনের ফ্ল্যাগ ছাড়াই আন্দোলনে নামতে হবে।’’ তবে উপাচার্যকে নিগ্রহের ঘটনা যারাই ঘটিয়ে থাকুক তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পার্থবাবু জানিয়েছেন। নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় এ দিন তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টা আমরা খুবই কড়া ভাবে দেখছি।
যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের দাবিকে সমর্থন করার প্রশ্ন নেই।’’ টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্রর মন্তব্য, ‘‘উপাচা‌র্যকে নিগ্রহ মানা যায় না। যদি প্রমাণ হয় ওই দু’জন তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, দল অবশ্যই কড়া ব্যবস্থা নেবে।’’

গত বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনার ঠিক পরপরই অস্থায়ী উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুগত মারজিত। শিক্ষক নিগ্রহে যুক্ত টিএমসিপি নেতাদের সেই সময় ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে কী করবেন সুগতবাবু? তাঁর মন্তব্য, ‘‘একেবারেই অন্যায়, অন্যায্য। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’

সরকারের লোক বলে পরিচিত সুগতবাবুও এ ভাবে নিগৃহীত হওয়ায় বিস্মিত শিক্ষাজগতও। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারের লোক যে ভাবে শাসক দলের ছাত্র নেতাদের হাতে নিগৃহীত হলেন তা আশ্চর্যজনক।’’ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘উপাচার্য বুদ্ধিমান মানুষ। দেরি করে হলেও তিনি সার সত্য বুঝেছেন।’’ এসএফআই এবং শিক্ষক সংগঠন কুটা ঘটনার নিন্দা করেছে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর বাহিনী এই কাজ করছে জেনে খুব অবাক হলাম না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন