রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্যে যতই কম করে দেখানো হোক, ডেঙ্গি যেন মাটি ফুঁড়ে বেরোচ্ছে। নভেম্বরের শুরুতেও যে ভাবে ডেঙ্গির দাপট অব্যাহত রয়েছে, তাতে এ বার ডিসেম্বর পর্যন্ত এই রোগ ভোগাবে বলেই মনে করছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা।
তাঁদের পর্যবেক্ষণ, বর্ষা বিদায় নেওয়ার পরেও বৃষ্টি না কমা, মশা মারার অভিযানে আশানুরূপ ফল না মেলা এবং মানুষ এখনও যথেষ্ট সচেতন না হওয়াতেই পরিস্থিতি ডেঙ্গি সংক্রমণের অনুকূল রয়েছে।
শুধু সংক্রমণই যে ছড়াচ্ছে তা-ই নয়, ডেঙ্গির নতুন কোনও ভাইরাস সক্রিয় হয়েছে কি না তা নিয়েও সন্দিহান পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা। কলকাতার এক কেন্দ্রীয় সরকারি গবেষণা সংস্থার পরজীবী বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ, অগস্টে হানা দিয়েছিল ডেঙ্গ টু এবং ডেঙ্গ ফোর ভাইরাস। সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অনেকের শরীরে তৈরি হয়ে গিয়েছে অ্যান্টিবডি। অর্থাৎ ওই নির্দিষ্ট প্রজাতির ভাইরাস আর কোনও ক্ষতি করতে পারে না তাঁদের শরীরে। কিন্তু এ বছর এক বার আক্রান্ত হওয়া রোগীর কারও কারও ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বারও সংক্রমণ ঘটেছে ডেঙ্গির। তাতেই নয়া ভাইরাসের আবির্ভাব নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পরজীবী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।
অগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা শহর ও তার আশপাশে ডেঙ্গিতে আক্রান্তদের শরীরে অনেক রকমের উপসর্গ দেখা গিয়েছে। সেই উপসর্গগুলির সঙ্গে বইয়ে লেখা ডেঙ্গি উপসর্গের অনেক অমিল। রোগীর শরীরে কোনও লালচে চাকা দাগ দেখা যাচ্ছিল না। প্লেটলেট হঠাৎ করে লাফিয়ে কমে যাচ্ছিল। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ফের জ্বরের সঙ্গে গায়ে লালচে দাগ দেখা যাচ্ছে কিংবা হাল্কা জ্বরের রোগীর মলের সঙ্গে রক্ত বেরোচ্ছে। যদিও ওই সব রোগীর প্লেটলেট খুব একটা কমছে না।
কিন্তু কবে ডেঙ্গিমুক্ত হবে কলকাতা বা সংলগ্ন অঞ্চল?
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এবং পুর-কর্তৃপক্ষ শীতের অপেক্ষায় থাকলেও তখনও পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হবে তা নিয়ে সন্দিহান পতঙ্গবিদরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, শীতের সময়ে ঘরের ভিতরে থেকে জমে থাকা পরিষ্কার জলে ডিম পাড়তে বিশেষ সমস্যা হবে না মশাদের। কারণ ঘরের ভিতরের তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রা থেকে অনেকটাই বেশি। যা মশার বংশবিস্তারের পথে বাধা হবে না। তবে শীতের সময়ে মানুষ গায়ে লেপ বা কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোন, শীতের পোশাকে হাত-পা সব ঢাকা থাকে- তাই মশা শরীরের খোলা অংশ কম পায়। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণের আশঙ্কাও কমে।
রাজ্য সরকার তথ্য চাপার প্রক্রিয়া বন্ধ করেনি। তা বলে ডেঙ্গি সংক্রমণ থেমে থাকেনি। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সর্বশেষ যে রিপোর্টটি পাঠানো হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সারা রাজ্যে এ বছর এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৯০০ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু কলকাতার ছ’টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য বলছে, শুধু সেখানেই জুলাই মাস থেকে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার জন ডেঙ্গি রোগী ভর্তি হয়েছেন। তা ছাড়া ওই বেসরকারি হাসপাতালগুলির আউটডোরে জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ৯ হাজার মানুষের রক্তের নমুনায় ডেঙ্গি মিলেছে। স্বাস্থ্য ভবন তথ্য দিতে রাজি নয়। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, শুধুমাত্র আইডি হাসপাতালেই প্রায় ৩ হাজার ডেঙ্গি রোগীর চিকিৎসা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, রাজ্য সরকার যত তথ্য গোপন করবে ততই পরিস্থিতি জটিল হবে। কারণ কোথায় কোথায় কত ডেঙ্গি রোগী রয়েছে তা জানা না গেলে রোগ প্রতিরোধের যথাযথ পরিকল্পনাই নেওয়া যাবে না। তার ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়বে। যেমনটা হয়েছে কলকাতা সংলগ্ন এলাকায়। দমদম, বিধাননগর, কলকাতা পুরসভা তথ্য চাপার চেষ্টা করায় বহু ডেঙ্গি আক্রান্ত এলাকাতেই মশার লার্ভা মারার কাজ হচ্ছে না বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা। সেই সব এলাকা থেকেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে রোগ। কলকাতার পাশাপাশি দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, বিষ্ণুপুর, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর এবং বারাসত মহকুমাতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে রোগ।
ডেঙ্গি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর সঙ্গে। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজাকেও ফোনে ধরা যায়নি। এসএমএসের জবাব দেননি তিনিও।