ফসলের বিষ ঝাড়তে রাজ্য এ বার মাঠে নামছে গুছিয়ে

জিভে জল আনা ভেটকির পদ ‘ফিশ করিয়েন্ডার’-এর অর্ডার নিতে এখন দু’বার ভাবতে হয়। ভবানীপুরের নামী কেটারার ভেবে থই পান না, কোত্থেকে আসবে ‘ভাল’ ধনেপাতা?

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৫
Share:

জিভে জল আনা ভেটকির পদ ‘ফিশ করিয়েন্ডার’-এর অর্ডার নিতে এখন দু’বার ভাবতে হয়। ভবানীপুরের নামী কেটারার ভেবে থই পান না, কোত্থেকে আসবে ‘ভাল’ ধনেপাতা?

Advertisement

শীতের বাজার উপচে পড়ছে ধনেপাতায়। অথচ টাটকা সবুজ পাতা ছিঁড়ে লাউয়ের ঘন্টে ফেলার পরে এক মাসিমার খেদোক্তি, ‘‘ধুস, কোথায় সেই গন্ধ! আগে ধনেপাতা শীতের বাজারের থলে থেকেই ম ম গন্ধ ছড়াত। এখন তো কচি লাউটার স্বাদও পানসে!’’ সেই ঘন্টেই পড়েছিল বাজারি কাঁচালঙ্কা। যা চিবিয়ে মেসোমশাইয়ের আক্ষেপ, ‘‘এটা লঙ্কা? আমার টবেরটা তো ঢের ভাল!’’

অভিযোগ শুনে শুকনো মুখে সবজি-বিক্রেতারা বলছেন, ‘‘যা সার পড়ছে, স্বাদ কি আর থাকে? চাষিকে তো ফলন বাড়াতে হবে।’’ ঘটনা হল, ফলনবৃদ্ধির তাগিদে শুধু রসনায় আপস নয়। স্বাস্থ্যেরও হানি হচ্ছে দস্তুরমতো। সৌজন্য, আনাজপাতির গায়ে লেগে থাকা কীটনাশক। পোকা মারার সে বিষ মানবদেহেও হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে। মনে পড়ে যায় আড়াই দশক আগে করা এক সুরসিকের উক্তি, ‘‘আমি বাজারে গিয়ে বেছে বেছে পোকাওয়ালা বেগুন কিনি। বেগুনে পোকা মানে পেস্টিসাইড নেই!’’

Advertisement

এ হেন সঙ্কটকালে রাজ্য কৃষি দফতর এগিয়ে এসেছে আশার বাণী নিয়ে। তাদের দাবি, চাল-ডাল-ফল-আনাজের স্বাদ ফেরাতে আর তাদের বিষ ছাড়াতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দাওয়াই— জৈব চাষ। মানে, ‘অর্গ্যানিক’ জিনিসপত্র ফলানো। যে লক্ষ্যে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে পরিকল্পনা করে বড় আকারে, সংগঠিত ভাবে সরকারি তরফে শুরু হয়েছে উদ্যোগ, কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা’র অধীনে। সময়সীমা তিন বছর। খরচের অর্ধেক কেন্দ্র দেবে। নতুন বছরে ‘জৈব চাষের রাজ্য’ হিসেবে ঘোষিত হতে চলেছে পড়শি সিকিম। তার পরে উত্তরাখণ্ডের পালা। পশ্চিমবঙ্গের টনক দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত নড়েছে।


সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন...

আর তাতে খুশি কৃষি মহলের একাংশ। যদিও বিশেষজ্ঞদের কারও কারও অভিমত, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারে মাত্রা রাখলে প্রথাগত চাষেই সমস্যার সমাধান হতে পারে। ‘‘জৈব চাষে বাণিজ্যিক সাফল্য কিন্তু সহজ নয়। প্রত্যাশিত ফলন পেতে সময় লাগে।’’— হুঁশিয়ার করছেন এক বিশেষজ্ঞ। ওঁদের পরামর্শ— নিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে চাষ হোক। তাতে ফলনের স্বাদ-সুরক্ষা বজায় থাকবে। উৎপাদনশীলতাও মার খাবে না। ফলে চাষির আর্থিক স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। রাজ্য কৃষি দফতরের অবসরপ্রাপ্ত কর্তা সুবীর চৌধুরী যেমন বলছেন, ‘‘প্রকল্পে না হয় সরকারি সহায়তা মিলবে। তার বাইরে সমস্ত চাষিকে পুরোপুরি জৈব চাষে ঠেলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তিন বছর ক্ষতি সহ্য করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়।’’ সুবীরবাবুর সুপারিশ, ‘‘তার চেয়ে প্রাথমিক ভাবে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হোক। যাতে খাদ্যে বিষের পরিমাণ কমে, আবার ফলনও ভাল হয়।’’

কিন্তু বিশেজ্ঞদের অন্য মহলের বক্তব্য: এটা অবাস্তব। কারণ, ক্ষেতে এক বার রাসায়নিক সার বা পোকা-আগাছা মারার বিষ দেওয়া শুরু হলে মাত্রা বাঁধা কার্যত অসম্ভব। উল্টে ব্যবহার ক্রমশ বাড়তেই থাকে।

এমতাবস্থায় কৃষি-বিজ্ঞানীদের বড় অংশের দাবি— অন্যতম সুরাহা হল একশো শতাংশ জৈব চাষ। আর তারই সূত্র ধরে রাজ্য সরকারের প্রয়াস। পশ্চিমবঙ্গে জৈব ফসল অবশ্য একেবারে অমিল নয়। শহরের হরেক শপিং মলে, এমনকী শিয়ালদহের কাছে সাপ্তাহিক ‘বিষমুক্ত হাট’-এ অর্গ্যানিক পণ্যের পসরা সাজানো থাকে। খদ্দেরও কম নয়, যদিও অধিকাংশ উচ্চকোটির মানুষ। সাধারণের কাছে জৈব খাদ্য কেনা বিলাসিতা। কেননা জৈব চাল-ডাল-ফল-সব্জির দাম বাজারের দ্বিগুণ-তিন গুণ। কেন?

কলকাতার বিবিধ মলে জৈব ফসল জোগানদার এক সংস্থার ডিরেক্টর অর্জুন গুপ্তের যুক্তি, ‘‘এখন যা হচ্ছে, প্রায় সব বেসরকারি প্রয়াসে। অল্প জায়গায় অল্প ফলন। তাই চাষের খরচ বেশি। সঙ্গে বাজারে আনা, প্যাকেজিংয়ের খরচ।’’ হাতে গোনা কয়েকটি গ্রামে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে জৈব চাষ হচ্ছে। কৃষি দফতরও বিচ্ছিন্ন ভাবে, অতি সামান্য জায়গায় জৈব চাষ করে। যেমন, নদিয়ার ফুলিয়ায় রাজ্যের কৃষি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের জৈব খামারে গত চোদ্দো বছর ধরে নানান ধান ও কিছু আনাজ ফলানো হচ্ছে জৈব প্রক্রিয়ায়। তবে সব মিলিয়ে উৎপাদন নগণ্য, দরও আমবাঙালির নাগালের বাইরে। অন্য দিকে রাসায়নিক চাষের বিস্বাদ ফসল ও তাতে শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনার কারণে রফতানির বাজারেও ধাক্কা খাচ্ছে বাংলা।

অগত্যা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে জৈব চাষ হবে আটটি জেলার মোট ছ’হাজার একরে। রাজ্যের কৃষি-অধিকর্তা পরিতোষ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে আগে একসঙ্গে এতটা জায়গা জুড়ে জৈব চাষ হয়নি।’’ কিন্তু যেখানে রাজ্যে চাষ-জমির পরিমাণ প্রায় দেড়শো লক্ষ একর, সেখানে এটুকুতে কী হবে?

কৃষি-কর্তাদের আশা, এটুকু সফল হলে সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পরিবর্তনের সূচনা করবে। কর্তারা অবশ্য বিলক্ষণ জানেন, ব্যাপারটা সহজ নয়। কারণ, বাংলার সিংহভাগ কৃষকের ধারণা, জৈব চাষে ফলন কম, খরচ বেশি। উপরন্তু ফসলে পোকা ধরার ভয় বিস্তর। ‘‘তিন বছরের প্রথম বছরটা কেটে যাবে শুধু এই ভুল ভাঙাতে।’’— মন্তব্য এক কর্তার।

জৈব চাষে এমন তো হয়েই থাকে! চাষিদের ধারণায় ভুলটা কোথায়?

বিশেষজ্ঞদের দাবি, জৈব চাষের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদে এমন কিছু সমস্যার আশঙ্কা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রভূত উপকার। তাঁদের ব্যাখ্যা— প্রথম বছরটা সব চেয়ে কঠিন। কারণ, দীর্ঘ দিন রাসায়নিক উপাদানে অভ্যস্ত জমির আড় ভাঙতে সময় লাগে। তখন খরচ বাড়ে। দ্বিতীয় বছরেও ফলন কম হতে পারে। ‘‘কিন্তু তৃতীয় বছরের পরে ভাল ফলন মিলবেই মিলবে।’’— ভরসা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।

এবং ওঁদের এ-ও আশ্বাস, আখেরে জৈব চাষের খরচ যথেষ্ট কমই দাঁড়াবে। কেননা চাষি তখন সার ও কীটনাশক নিজেই বানাবেন। পাশাপাশি ঠিকঠাক বীজ বাছলে পোকা ধরবে না। কৃষি-বিজ্ঞানী প্রদীপ সেনের কথায়, ‘‘এ অনেকটা ফ্লাইওভার তৈরির সময়ে দেওয়া সরকারি স্লোগানের মতো। টুডেজ পেন, টুমরোজ গেন। এখন ধৈর্য ধরুন। শেষে দেখবেন, লাভই লাভ।’’ জৈব চাষের সঙ্গে যুক্ত রুবি রায় বলছেন, ‘‘তবে পাশের জমির রাসায়নিক কীটনাশক যেন জলবাহিত হয়ে জৈব চাষের ক্ষেতে না ঢুকে পড়ে! তা হলে আসল উদ্দেশ্যই মাঠে মারা যাবে!’’

প্রকল্প সম্পর্কে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও আশাবাদী। ‘‘এখনই সবটা হয়তো করা যাবে না। তবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের উপরে অত্যধিক নির্ভরতা কাটানোর জন্য একটা ধাক্কা যদি অন্তত দেওয়া যায়, সেটাই যথেষ্ট।’’— মন্তব্য মন্ত্রীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন