খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধায় মন দিয়েছে রাজ্য

শীতের প্রিয়তম সম্পদ নলেন গুড় রক্ষায় এ বার সেই খেজুর গাছ পরিচর্যার ‘রোড-ম্যাপ’ গড়ে উঠছে রাজ্যে।

Advertisement

ঋজু বসু ও সুস্মিত হালদার

কলকাতা ও কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:০০
Share:

গাছের ‘জোয়ার আসিলে’, সে-গাছ কৌশলে কাটতে বলেছিলেন সাধক-কবি! নইলে গাছ বা গাছের ফসল কিছুই থাকবে না।

Advertisement

শীতের প্রিয়তম সম্পদ নলেন গুড় রক্ষায় এ বার সেই খেজুর গাছ পরিচর্যার ‘রোড-ম্যাপ’ গড়ে উঠছে রাজ্যে। নদিয়ার মাজদিয়ায় রাজ্য খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদের নলেন গুড় প্যাকেজিং প্রকল্পের সুবাদে নেকনজরে এসেছে বেশ কিছু খেজুর গাছ। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরেও স্থানীয় সাংসদের তহবিল ও পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের সহায়তায় শুরু হয়েছে ‘খেজুর গুড় হাব’ গড়ার কাজ। আর বাঁকুড়া-১, ওন্দা, ইন্দাস লাগোয়া ১৫টা গ্রামের ৩০০ চাষির মহাজোটে নলেন গুড়ের চাষি-উৎপাদকেরা ‘কোম্পানি’ গঠন করতে চলেছেন।

এ যুগে সস্তার চিনি-সহ গুচ্ছের ভেজাল-বিশিষ্ট নলেন গুড়ের রমরমা। খেজুর গাছের প্রতি অত্যাচারই এর কারণ বলে মনে করেন গুড় কারবারিরা। নদিয়ার হাঁসখালির গুড় সংগ্রাহক সাজিদ দফাদারের কথায়, ‘‘মানুষের মতো গাছও জিরেন চায়! নইলে রস ফুরিয়ে কপালে অকাল মরণ।’’ জিরেন মানে গাছের বিশ্রাম। খেজুরগাছের কাণ্ডে কাটাকুটি করে রসের আশায় হাঁড়ি বেঁধে শুরু হয় অপেক্ষা। কিন্তু রোজ কাটাকুটিতে গাছের দফারফা। তিন থেকে সাত দিন বিশ্রামের পরে ‘জিরেনকাট’-এর রসের গুড়ই সর্বোৎকৃষ্ট বলে মনে করেন কুলীন সন্দেশ-স্রষ্টারা। নদিয়ার দেবগ্রামের ধাওয়াপাড়ার প্রবীণ গুড়চাষির হিসেবে, ‘‘খেজুর গাছের শরীরে রসের জোয়ার আসে ১৪-১৫ বছরে। যত্ন পেলে ৩৫-৪০ বছর তার রসের গন্ধ ম-ম করবে!’’

Advertisement

সেরা পয়রা বা পাটালির আশাতেই খাদির অবসরপ্রাপ্ত এক কর্তার চেষ্টায় বাঁকুড়ায় গুড়চাষিদের চোখ খোলার কাজ শুরু হয়েছে। এই কাজের নেপথ্যে থাকা সংস্থার এক কর্তা সৌরভ ঘোষ বলছিলেন, ‘‘গাছ বাছাই থেকে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির ধাপে ধাপে গাছ মালিক, শিউলিদের (গুড় সংগ্রাহক) ভুলচুক শুধরোনো চলছে! মাটির হাঁড়ি পুড়িয়ে প্রস্তুত করা বা গুড়ের ক্যালসিয়াম উপাদান মেপে, পদে পদে সতর্কতা।’’ বিশেষজ্ঞদের মতে, একফোঁটা চিনিও সেরা গুড়ের শত্রু। চিনির দৌলতে জমা আর্দ্রতায় গুড় দ্রুত নষ্ট হয়! সম্প্রতি কলকাতার উপকণ্ঠে জৈব ও প্রাকৃতিক ফসল উৎকর্ষের একটি মেলায় বাঁকুড়ার ‘চিনিবিহীন গুড়ে’র সন্দেশ তৈরি করেও দেখেছেন কলকাতার নামী মিষ্টিপ্রস্তুতকারক সুদীপ মল্লিক।

চিনিবিহীন গুড়ের সাধনা চলছে নদিয়ার মাজদিয়াতেও। বছর দুই আগে থেকেই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিট অব প্যাকেজিংয়ের সহায়তায় টুথপেস্টের মতো টিউব-বন্দি নলেন গুড় নিয়ে বাজার ধরতে নেমেছিল রাজ্যের খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ। মাজদিয়ার ‘শ্রীকৃষ্ণ নলেন গুড় উৎপাদক সমিতি’ নামে এক স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ১২ হাজার টিউবে নলেন গুড় ভরার বরাত দিয়েছিল খাদি। দু’টো শীত পার করেই বারো হাজার থেকে লক্ষ্যমাত্রা পৌঁছেছে লাখে। ‘বিশ্ববাংলা’র স্টল থেকে টিউব নিয়ে যাচ্ছেন নলেনের নেশা ধরা বিদেশিরাও।

চাহিদা এমনই লাফিয়ে বাড়ছে যে হাতে চালানো যন্ত্র দিয়ে টিউবে গুড় ভরে আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। মাজদিয়ার ভাজনঘাটে প্রায় চার কোটি টাকা খরচে আস্ত কারখানা বানাচ্ছে রাজ্য। খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ইতিমধ্যে ওই কারখানায় গুড় তৈরি শুরু হয়ে গিয়েছে।” ফেব্রুয়ারির গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রী এসে কারখানাটির উদ্বোধন করবেন, এমন কথা চলছে।

গত বছর ৩৫ হাজার টিউব গড়ার পরে এখন এক লক্ষের লক্ষ্যমাত্রা খাদি পর্ষদের। চেয়ারম্যান গৌরীশঙ্কর দত্ত বলছিলেন, ‘‘উৎকৃষ্ট গুড়ের জন্য ২০০০ খেজুর গাছ বাছাই করা হয়েছে। ভেজাল ছাড়া গুড় মেলাটাই কঠিন। আমরা তা জোগাতেই চাহিদাটা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।’’ বাঁকুড়ার প্রকল্পে একটি গাছ কাটা হলে পাঁচটি গাছ রোপণের শপথ। পুরুলিয়াতেও ১০০ দিনের কাজে প্রতি পঞ্চায়েতে ৪-৫ হাজার গাছ বসানোর লক্ষ্যমাত্রা। সুন্দরবনের কাছে বাসন্তী, নদিয়ার হাঁসখালি, দেবগ্রামের গুড় কারবারিদের একাংশও গুড়ের মানরক্ষায় সচেতন।

নকুড় নন্দীর উত্তরপুরুষ পার্থ (রাজা) নন্দীর কথায়, ‘‘চিনিবিহীন গুড়ে সন্দেশ তৈরি শুরু হয়নি। তবে সামান্য চিনির পাতলা, সুগন্ধী গুড় ঠিক চিনে নিই।’’ তাঁরও মত, সঠিক পথে উৎপাদন না-হলে নলেনের নাম অচিরে শুধু ইতিহাসেই লেখা থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন