স্বশাসনে আপস নয়, বার্তা রাজ্যপালের

রাজ্য সরকার যে-হেতু টাকা দেয়, তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করতেই পারেন বলে শুক্রবার ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সোমবার আচার্য তথা রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী বুঝিয়ে দিলেন, মন্ত্রীর এ হেন মনোভাবের সঙ্গে তিনি সহমত নন। এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের সঙ্গে কথোপকথনের সময়েই রাজ্যপালের এই অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৯
Share:

রাজ্যপালের চিঠি পড়ে শোনাচ্ছেন সুরঞ্জন দাস। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

রাজ্য সরকার যে-হেতু টাকা দেয়, তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করতেই পারেন বলে শুক্রবার ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সোমবার আচার্য তথা রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী বুঝিয়ে দিলেন, মন্ত্রীর এ হেন মনোভাবের সঙ্গে তিনি সহমত নন। এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের সঙ্গে কথোপকথনের সময়েই রাজ্যপালের এই অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে আচার্যের সঙ্গে কথা বলতে এ দিন বিকেলে রাজভবনে গিয়েছিলেন সুরঞ্জনবাবু। দেড় ঘণ্টা আলোচনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মী- শিক্ষকদের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি তাঁর হাতে তুলে দেন আচার্য। তাতে কেশরী কয়েকটি বিষয়ে নিজের মতামত স্পষ্ট করেছেন। আচার্যের চিঠি হাতে নিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘‘রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার রক্ষায় দ্রুত নিয়ম-বিধি (স্ট্যাটুট) তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন।’’ কত দিনের মধ্যে তা তৈরি হবে, সে নিয়ে অবশ্য উপাচার্য কোনও মন্তব্য করেননি।

পদাধিকারবলে রাজ্যপালই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনার রিপোর্ট তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগেই জমা পড়ে গিয়েছিল শিক্ষামন্ত্রীর টেবিলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর এ ভাবে রিপোর্ট চাওয়াটা স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছিল। আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়, অশোকনাথ বসুর মতো অবসরপ্রাপ্ত উপাচার্যেরা ঘটনাটিকে সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেন। আচার্যের আগে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে গিয়ে উপাচার্য রিপোর্ট পেশ করায় তা নিয়েও সমালোচনার ঝড় ওঠে শিক্ষাবিদ মহলে।

Advertisement

পাশাপাশি রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাকা দেয় বলে ফিনান্স অফিসার সংক্রান্ত বিতর্কেও সরাসরি হস্তক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। তা ঘিরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারভঙ্গের অভিযোগ উঠেছিল। এ দিন কেশরী ফিনান্স অফিসারের নিয়োগ ও আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত সব রিপোর্ট তলব করেছেন। আন্দোলনরত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের পর্যবেক্ষণ, এর মাধ্যমে রাজ্যপাল বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, এ বিষয়টিতেও শিক্ষামন্ত্রী এক্তিয়ার ভেঙেছেন। মন্ত্রীর কী বক্তব্য?

পার্থবাবু এ দিন বলেন, ‘‘পঠনপাঠনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার অবশ্যই আছে। নিজের নিজের অধিকার সকলে নিরপেক্ষ ভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন, এটাই তো স্বাধিকার।’’ কিন্তু স্বাধিকার মানে যে আর্থিক বিশৃঙ্খলা নয়, তা মনে করিয়ে দিয়ে পার্থবাবুর মন্তব্য, ‘‘জনগণের দেওয়া টাকা সরকার কোথায় খরচ করছে, তার হিসেব জনগণ আমাদের কাছে চাইবে। দুর্নীতি হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটা আমরা সব সময়ই চাইব।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর থেকেই যে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল এবং তার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কমিটি তদন্ত করেছে ও সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে— এ সব তথ্য উল্লেখ করে পার্থবাবুর প্রশ্ন, ‘‘এখানে সরকার স্বাধিকার ভঙ্গ করল কোথায়?’’ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়মের ঘটনাকে ছাড় দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, আজ, মঙ্গলবার তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার রক্ষার স্বার্থে স্ট্যাটুট তৈরির নির্দেশ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমাদের আপত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ই বিধির খসড়া তৈরি করে দিক না! তার পরে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে।’’

ফিনান্স অফিসার সংক্রান্ত ফাইল শিক্ষা দফতরে তলব করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এ দিন রাজ্যপাল এ সংক্রান্ত সব ফাইলই চেয়ে পাঠিয়েছেন। বিকাশ ভবনের খবর, বিষয়টি নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলতে পারে শিক্ষা দফতর। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ হওয়ার যে কোনও প্রশ্ন নেই, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তা ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন।

এ দিকে গত বুধবার শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনার পরেই অভিযোগ উঠেছিল, হামলাকারীদের মধ্যে
বহিরাগতেরা ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ দিন রাজ্যপালের পরামর্শ: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাতে বহিরাগতেরা না-ঢোকে, সে দায়িত্ব ছাত্র সংসদকেই নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে
ছাত্র সংসদ যাতে উপাচার্যকে সহযোগিতা করে, তার উপরেও জোর দিয়েছেন রাজ্যপাল।

উপাচার্য সুরঞ্জনবাবু জানিয়েছেন, শিক্ষক নিগ্রহে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর: এ ব্যাপারে রাজ্যপাল তাঁকে ‘কড়া মনোভাব’ নিতে বলেছেন। সুরঞ্জনবাবু বৃহস্পতিবারই শিক্ষামন্ত্রীকে জানিয়ে এসেছিলেন, নিগ্রহের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া না-হলে পদত্যাগ করবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ তো এফআইআর দায়ের করেননি! তা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা কী ভাবে হবে?

সুরঞ্জনবাবুর জবাব, ‘‘এফআইআর ছাড়াও অন্য যে ভাবে সম্ভব, সে ভাবেই হবে।’’

রাজ্যপালের দাওয়াই এবং সুরঞ্জনবাবুর মন্তব্য প্রসঙ্গে টিএমসিপি-র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৌরভ অধিকারী কোনও মন্তব্য করতে চাননি। গত বুধবার তাঁরই নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপরে হামলা হয়েছিল বলে অভিযোগ। শিক্ষামন্ত্রীর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ১৭১টি কলেজ আছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত বলে ওই সব ক’টি কলেজেই যখন তখন গিয়ে যা খুশি করতে পারি, তা-ই কখনও হয়? উপযুক্ত কারণ ছাড়া এবং কর্তৃপক্ষকে না-জানিয়ে বাইরের কেউ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে না ঢোকে, তা দেখতে হবে। শিক্ষক, ছাত্র এবং বিশিষ্ট জন— সকলের ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রযোজ্য হবে।’’ একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথ মঞ্চের আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে এ দিন ফের প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। ‘‘এক জন আধিকারিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে শিক্ষকেরা আন্দোলনে নামবেন কেন? ছাত্রেরাই বা জড়াবে কেন? শিক্ষা-কর্মচারীদের সংগঠন এ নিয়ে কথা বলতে পারে।’’— মত পার্থবাবুর।

নির্দিষ্ট সংগঠনের বদলে যৌথ মঞ্চ গড়ে অবস্থান-বিক্ষোভ চালাচ্ছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা, যাঁদের উদ্দেশেও এ দিন বার্তা দিয়েছেন আচার্য। উপাচার্যের কথায়, ‘‘অবস্থানরত শিক্ষকদের প্রতিনিধিরা চাইলে আচার্যের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আচার্য তাঁদের অবস্থান তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। আচার্যের চিঠি মঙ্গলবার সকালেই যৌথ মঞ্চের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’’

যৌথ মঞ্চের সদস্যেরা এ দিনও উপাচার্যের ঘরের সামনে অবস্থানে বসেছিলেন। তা নিয়ে কটাক্ষ করে তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতি পোস্টারও লাগায়। বিকেলে আচার্যের বার্তা পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনের (কুটা) সাধারণ সম্পাদক দিব্যেন্দু পাল বলেন, ‘‘আচার্য ডাকলে আমাদের না-যাওয়ার কারণ নেই।’’

এ দিন উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন প্রাক্তন উপাচার্য। পরে ওই দলের সদস্য— বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত করাতে হবে। ফিনান্স অফিসারের দুর্নীতির তদন্ত শেষ না-হলে উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যেতেও নিষেধ করেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন