পশ্চিমবঙ্গের মাটির তলায় জলভাণ্ডারের অবস্থা আরও সঙ্গিন। এ রাজ্যে মাটির তলার জলভাণ্ডার প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ব্লকের সংখ্যা ২০০৯-এর তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় ভূজল নিগমের রিপোর্টের এই তথ্য রাজ্য সরকার প্রথমে মানেনি। কিন্তু রাজ্যের নিজস্ব ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ও একই রিপোর্ট দিয়েছে।
রাজ্যে ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডারের অবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল রাজ্য। কেন্দ্রীয় ভূজল নিগমের ( সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড বা সিজিডব্লিউবি) সমীক্ষা নাকচ করতে রাজ্য জল অনুসন্ধান দফতরের ভূতত্ববিদ অফিসারদের নিয়ে ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গড়ে নতুন করে সমীক্ষা করায় নবান্ন। কিন্তু রাজ্যের বিশেষজ্ঞেরাও রিপোর্ট দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সমীক্ষা মেনে নেওয়াই উচিত।
কেন্দ্রীয় ভূজল নিগম সম্প্রতি ২০১৪ সালের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতেই এ রাজ্যের জলভাণ্ডারের সঙ্গীন অবস্থার ছবি রয়েছে। মাটির তলা থেকে জল তুলে নিঃশেষ করে দেওয়ার ব্যাপারে এ রাজ্যে বাম আমলে বহু বছর ধরে বিপজ্জনক তকমা ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর ২ নম্বর ব্লকের। নতুন সমীক্ষায় ভরতপুরের নামোল্লেখ নেই। তার বদলে কেন্দ্রীয় সমীক্ষা দেখিয়েছে, ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডার প্রায় নিঃশেষ করে দেওয়া হয়েছে হুগলি জেলার গোঘাট ২ নম্বর ব্লকে।
কেন্দ্রীয় সমীক্ষকদের হিসেবে, এ রাজ্যে মাটির তলা থেকে বাধাহীন ভাবে জল তোলার ফলে ২০০৯ সালের চেয়ে ‘আধা বিপজ্জনক’ ব্লক এখন ৩৯.৪৭ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।
জলভাণ্ডার নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পিছনে আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন সমীক্ষকেরা। তাঁরা বলেছেন, এ রাজ্যে ব্যাপক সবুজ ধ্বংসের জন্য বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০০৯ সালের চেয়ে মারাত্মক ভাবে কমে গিয়েছে। এ ছাড়া, ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা গিয়েছে জনসংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই হু হু করে বেড়ে গিয়েছে অবৈধ টিউবওয়েলের সংখ্যাও।
ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য বৃষ্টি ও নদীর জল থেকে ‘রিচার্জ’ করার কাজে জোর দিতে বলে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক। এই মন্ত্রকের প্রকাশিত ২০১৩-২০১৪ সালের ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার ইয়ার বুক’-এ বলা হয়েছে, শুষ্ক বলে পরিচিত দিল্লি, হরিয়ানা, পঞ্জাব ও রাজস্থানে ভূগর্ভস্থ জলের উন্নয়নের কাজ ১০০ শতাংশেরও বেশি হয়েছে। এ সব রাজ্যে একই উন্নয়নের কাজ হয়েছে ৭০ শতাংশেরও বেশি। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নাম রয়েছে সবার শেষে। এখানে তৃণমূল সরকারের সগর্ব ঘোষণা ‘জল ধর জল ভর’ সত্ত্বেও ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডারের জন্য উন্নয়নের কাজ হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ।
রাজ্য জলসম্পদ দফতরের এক সূত্র জানান, কেন্দ্রীয় সমীক্ষার রিপোর্ট পুনরায় পরীক্ষার জন্য রাজ্য জল অনুসন্ধান বিভাগের অফিসারদের নিয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’ কমিটি গড়া হয়। এই কমিটিও কেন্দ্রীয় সমীক্ষার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে সম্প্রতি রিপোর্ট দেয়। কিন্তু সেই রিপোর্ট নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর চূড়ান্ত ভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিয়ে আটকে রেখেছে বলে জানান জল অনুসন্ধান দফতরের সূত্রটি।
রাজ্য জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের একাংশ ভূতাত্বিক অফিসার মনে করেন, শুধু অবৈধ গভীর নলকূপ নয়, তাঁদের দফতরের এক প্রাক্তন সচিবের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে ৫ অশ্বশক্তি সম্পন্ন পাম্প বসানোর উপর থেকে সব রকম নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় গত বছর। তার পর থেকে ভূগর্ভস্থ জল আরও দ্রুত কমছে। জেলায় জেলায় ভূগর্ভের জলে আর্সেনিক, ফ্লুরাইডের পরিমাণ বাড়ছে।