সিবিএসসি-র ধাঁচে বদল আসুক রাজ্য বোর্ডের সিলেবাসে, দাবি অভিভাবকদের

মধ্য শিক্ষা পর্ষদই হোক, কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ-ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের স্বার্থে কেন সিলেবাস এবং প্রশ্নপত্র সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন বা সিবিএসই বোর্ডের ধাঁচে কেন হবে না এবার সেই প্রশ্নটা উঠে গেল।

Advertisement

মধুরিমা দত্ত, তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ১৬:৪৭
Share:

মধ্য শিক্ষা পর্ষদই হোক, কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ-ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের স্বার্থে কেন সিলেবাস এবং প্রশ্নপত্র সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন বা সিবিএসই বোর্ডের ধাঁচে কেন হবে না এবার সেই প্রশ্নটা উঠে গেল।

Advertisement

আর প্রশ্নটা এল খোদ অভিভাবকদের তরফ থেকে। অভিভাকদের যুক্তি, সিলেবাস এবং প্রশ্নের ধরণ আগে থেকেই সিবিএসই বোর্ডের মতো হলে এবার সর্বভারতীয় স্তরে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি এন্ট্রান্স টেস্ট (নিট) এমন নাস্তানাবুদ হতে হত না রাজ্যের পড়ুয়াদের। দিল্লিতে গিয়ে বৈঠক করতে হত না রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে গিয়ে এমন ভাবে আবেদন নিবেদন করতে হত না।

শুধু নিট কেন, সর্বভারতীয় স্তরে গবেষক বাছাইয়ের পরীক্ষা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট (নেট)—এরও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে সিবিএসই বোর্ড। শুধু তাই নয়, সর্বভারতীয় স্তরের বেশির ভাগ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই তৈরি হয় সিবিএসসি ধাঁচে। তাই ওই সব পরীক্ষায় সিবিএসই বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়ছেন রাজ্যের বোর্ডের পড়ুয়ারা। সিলেবাস হোক বা প্রশ্নের ধাঁচ— প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় বসতে গিয়ে বাড়তি চাপে জেরবার হচ্ছেন বাংলা বোর্ডের ছাত্র-ছাত্রীরা। অভিভাবকদের অনেকেই বলছেন, সর্ব ভারতীয় স্তরে এ রাজ্যের পড়ুয়াদের টেনে তোলার চেষ্টা তখনই সার্থক হবে, যখন সিবিএসই-র প্রশ্ন ও সিলেবাসের সঙ্গে সড়গড় হবে এ রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা।

Advertisement

সবাই না বুঝলেও, বিষয়টি বুঝেছে কলকাতার অনেক স্কুলই। যেমন সাউথ পয়েন্ট স্কুল। দুই বছর আগে সিবিএসই পাঠ্যক্রম চালু করেছিলেন স্কুল-কর্তৃপক্ষ। তবে পুরোটা নয়। সিবিএসই এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ— নিজেদের পছন্দ মতো বোর্ড বেছে নিতে পারত ছাত্রছাত্রীরা। এখন সিবিএসই-র পক্ষেই অধিকাংশ অভিভাবক মত দেওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে ওই স্কুলের কোনও ছাত্রছাত্রীই আর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে না। পুরোটাই চলে যাচ্ছে সিবিএসই স্তরে। মাধ্যমিক স্তরেই পুরো বদল আনছে দক্ষিণ কলকাতার ওই স্কুলটি। কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ‘‘২০১৮ সালে আমাদের শেষ মাধ্যমিক ব্যাচ পরীক্ষা দেবে। তারপরে সব সিবিএসই।’’

একই ভাবে গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলেও দশম এবং দ্বাদশ দুটি শাখাই সিবিএসই বোর্ডে চলে গিয়েছে ২০১৫ সালে। কেন? স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ‘‘যেহেতু সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলি এখন সিবিএসই সিলেবাস মেনে হয়, তাই আমরা চেয়েছিলাম আমাদের মেয়েরা যাতে ভবিষ্যতে সমস্যায় না পড়ে। তা ছাড়া অভিভাবকদের তরফেও দাবি উঠেছিল।’’ সাউথ পয়েন্টে দুটি বোর্ড চলছে পাশাপাশি। সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় সফন হতেই এই বোর্ড পরিবর্তন? স্কুল-কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ‘‘ছাত্রদের মেধা নাকি সিবিএসই-র পাঠ্যক্রম, কোনটা প্রতিয়োগিতায় টিকে থাকতে বেশি সাহায্য সেটি বিচার করার সময় এখনও আসেনি। তবে পুরোটা সিবিএসই-তে পরিবর্তনের চাপটা অভিভাবকদের তরফ থেকেই এসেছে। ওঁরা সিবিএসই বোর্ডকেই বেছে নিচ্ছেন।’’

কেন রাজ্য বোর্ডের থেকে সিবিএসই বেশি গ্রহযোগ্য তাঁদের কাছে? গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের এক শিক্ষাবিদ অভিভাবক বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ-সহ মহারাষ্ট্র, কেরল, জম্মু ও কাশ্মীর, মণিপুর, গুজরাতের নিজস্ব বোর্ডের পাঠ্যক্রম ধরাবাঁধা গতের বাইরে গিয়ে ভাবতে দিচ্ছে শেখাচ্ছে না পড়ুয়াদের। এ ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে সিবিএসই বোর্ডের পড়ুয়ারা।’’ ওই অভিভাবক বলেন, ‘‘সিবিএসইর আওতাধীন একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞানবিভাগের পড়ুয়াদের এমন সব বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ লিখতে বলা হয় যাতে একদিকে যেমন পড়ুয়াদের ভাবনা চিন্তার উন্নতি হয়, অন্যদিকে বাঁধাধরা সিলেবাসের বাইরে গিয়ে বিকল্প কিছু ভাবতেও শেখা যায়।’’ সাউথ পয়েন্ট স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘সিবিএসই বোর্ডে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল প্রশ্নের ধরণ। মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের সঙ্গে ছোট বেলা থেকে সড়গড় থাকায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অন্যান্য বোর্ডকে সহজেই টেক্কা দিচ্ছে সিবিএসই বোর্ডের পড়ুয়ারা।’’

সিবিএসই বোর্ডের সঙ্গে রাজ্য বোর্ডের তুলনা টেনে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান শিক্ষক স্বামী বেদপুরুষানন্দ বলেন, ‘‘সিবিএসই বোর্ডের ব্যপ্তি অনেক বেশি, কিন্তু সেই অর্থে পঠনপাঠনের গভীরতা নেই। বরং রাজ্যের সিলেবাসে বিষয়ের বৈচিত্র্য কম হলেও তার গভীরতা অনেক বেশি।’’ স্বামী বেদপুরুষানন্দ বলেন, ‘‘আমরা পড়ুয়াদের এনসিইআরটি-র বই সহায়িকা হিসেবে পড়তে বলি। এখন আমাদের সিলেবাসও সেই দিকেই ঝুঁকেছে বলে একটা সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। তবে সিলেবাস বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদেরও প্রকৃত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নয়া পদ্ধতিতে পড়াতে হলে শিক্ষকদেরও সেইমতো মানসিকতা বদল প্রয়োজন।’’

আরও পড়ুন

নেই শূন্যপদে নিয়োগ, শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে রাজ্যের মাদ্রাসাগুলো

বোর্ড বদলাতে রাজি নয় নরেন্দ্রপুর। বোর্ড পালটাতে রাজি নয় পাঠভবন, হেয়ার স্কুলও। পাঠ ভবন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা রায়ের মন্তব্য, ‘‘উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাস আগেই পাল্টেছে, বদলেছে প্রশ্নের ধরণ। আগামী বছর থেকে মাধ্যমিকেও বদল আসছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে সর্বভারতীয় স্তরের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতেই এ রাজ্যের বোর্ড এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মহুয়া দাস বলেন, ‘‘এই রাজ্যে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম অনেকখানিই সাজানো হয়েছে সিবিএসইর ধাঁচে। সেইমতো মাধ্যমিকেও প্রশ্নের ধরণ হতে চলেছে সংক্ষিপ্ত এবং অতিসংক্ষিপ্ত। আমাদের পাঠ্যক্রম অনেক বিস্তৃত। এমনকি স্নাতকস্তরে পড়ুয়ারা জানতে পারবে এমন অনেক বিষয়ও অল্পবিস্তর আমরা পাঠ্যক্রমে নিয়ে এসেছি।’’

এই অবস্থায় বদল হচ্ছে ইন্ডিয়ান সার্টিফিকেট অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন (আইসিএসই)-র প্রশ্নপত্রেও। আইসিএসই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ২০১৮ থেকে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক প্রশ্নের ধরণেই পরীক্ষা হবে তাঁদেরও। তবে সিবিএসই তাদের মডেল নয়, মডেল সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলি। তাই সেইভাবেই পড়ুয়াদের প্রস্তুত করতে ব্যবস্থা নিচ্ছেন আইসিএসই কর্তৃপক্ষ। আইসিএসই-র মুখ্য কার্যনির্বাহী সম্পাদক জি অ্যারাথন বলেন, ‘‘সিবিএসই বোর্ডে পড়লে পড়ুয়া ভালো ফল করবে এটা অভিভাবকদের ধারণা। ঘটনাটা মোটেও এরকম নয়। ওদের পরীক্ষার্থী বেশি, তাই সাফল্যের হার বেশি। কিন্তু সিবিএসই বোর্ডে না পড়লে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে এমনটা ঠিক না। আমরাও সেই প্রতিযোগিতায় তাল মিলিয়েই সিলেবাসে বদল আনছি।’’

সিবিএসই-ই যে শেষ কথা এমনটা মানতে চান না এই রাজ্যের শিক্ষকদের অধিকাংশই। তাঁরা বলছেন, সিবিএসই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পড়ুয়াদের এগিয়ে রাখে ঠিকই, কিন্তু এর বাইরেও যে অন্য পড়াশোনার বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে তা নিয়ে ভাবার অবসর দেয় না। সিবিএসই-ই যে উত্কৃষ্ট বিকল্প তা এখনই জোর দিয়ে বলতে নারাজ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, ‘‘সব স্কুল সিবিএসইর আওতায় এলে আঞ্চলিক ভাষাগুলি বিপদে পড়বে। তবে বিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিষয়গুলি যদি অন্য বোর্ডের থেকে সিবিএসই বেশি সময়োপযোগী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন