মাস তিনেক আগের কথা।
এক দুপুরে আচমকাই একটি ফোন আসে স্বাস্থ্য ভবনে। টালিগঞ্জের এক বাসিন্দা এলাকার এক নার্সিংহোম সম্পর্কে কিছু তথ্য দিতে চেয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, গত দু’মাসে ওই নার্সিংহোমে যত প্রসব হয়েছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু বাঁচেনি। অত্যন্ত কম ওজনের শিশু জন্মেছে জানিয়ে নার্সিংহোম প্রতিটি ক্ষেত্রে শিশুর বাড়ির লোকেদের জানিয়েছে, সৎকারের ব্যবস্থা তারাই করে দেবে।
এতেই শেষ নয়। ফোনে ওই বাসিন্দা এ-ও জানিয়েছিলেন, মাঝেমধ্যেই নার্সিংহোমে কিছু সন্দেহজনক লোকজনের আনাগোনা হয়। বেশিরভাগই গভীর রাতে। দিন কয়েক আগে পাড়ার লোকেরা সেখানে চড়াও হয়েছিলেন। স্থানীয় থানাতেও অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু থানা অভিযোগ নেয়নি।
তার পর? স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তা সোমবার এই ঘটনার কথা বলছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘তারপর কিছুই হল না। আর পাঁচটা ফোনের মতো রিসিভার নামিয়ে রাখার পর সংশ্লিষ্ট আধিকারিক ফোনের কথা ভুলে গেলেন। ঘরে সেই সময় যাঁরা ছিলেন, এ বিষয়ে দু’চারটে কথাবার্তার পর তাঁরাও আর উচ্চবাচ্য করেননি।’’
এ থেকেই পরিষ্কার, নার্সিংহোমের কাজকর্ম নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের গা ছাড়া মনোভাবও শিশু পাচার চক্রকে ফুলেফেঁপে উঠতে অনেকটা সাহায্য করেছে। বহু শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ার খবর সামনে আসার পরে এত দিনে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে স্বাস্থ্য দফতর। স্থির হয়েছে, রাজ্যের সব নার্সিংহোম থেকে এ বার নিয়মিত ‘পারফরম্যান্স রিপোর্ট’ চৈওয়া হবে। সেই রিপোর্টে নার্সিংহোমে কী কী পরিষেবা দেওয়া হয়, প্রসব ও গর্ভপাত হয় কিনা, থাকলে তার সংখ্যা কত, কতগুলি শিশু প্রসবের সময়ে মারা গিয়েছে, মৃত্যুর কারণ কী, মৃত সদ্যোজাতদের দেহগুলি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কিনা, তার সবিস্তার তথ্য থাকবে। থাকবে প্রসবের জন্য আসা মহিলাদের নাম ও বাড়ির ঠিকানাও। শুধু তাই নয়, নার্সিংহোমগুলি সঠিক রিপোর্ট দিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে কলকাতা ও জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদের আচমকা নার্সিংহোম পরিদর্শনে যাওয়ার নির্দেশও দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্যে শিশু পাচার চক্রের বিষয়টি সামনে আসার পরে স্বাস্থ্য দফতরকে গত শনিবার একটি চিঠি দেয় রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ। তার পরেই সোমবার এই সিদ্ধান্ত হয় বলে স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে লাইসেন্স পাওয়া নার্সিংহোমগুলিকে চলতি সপ্তাহেই এই নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
প্রশ্ন হল, লাইসেন্স ছাড়াও কলকাতা-সহ রাজ্যের সর্বত্র অগুন্তি নার্সিংহোম রয়েছে। সেগুলির ক্ষেত্রে কী হবে? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, ‘‘সে ক্ষেত্রে আমরা সাধারণ মানুষের উপরে অনেকটাই ভরসা করব। স্থানীয় স্তরে কোন নার্সিংহোমে সন্দেহজনক কী হচ্ছে, তার আঁচ পান এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা যদি আমাদের খবর দেন, তা হলে খোঁজখবর নিয়ে আমরাই এফআইআর দায়ের করব।’’ কিন্তু এত দিন কি তা হলে জেগে ঘুমোচ্ছিল স্বাস্থ্য দফতর? স্বাস্থ্য অধিকর্তা এ কথা পুরোপুরি মানতে চাননি। তবে, লোকবলের অভাবে যে বহু সময় পরিদর্শনের কাজে সমস্যা হয়, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি।
যদিও স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে অন্য কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আধিকারিকরা অনেকেই জানিয়েছেন, এখন সাধারণ মানুষের সহযোগিতা চাওয়ার কথা বলা হলেও আদতে সাধারণ মানুষের দেওয়া তথ্যকে গুরুত্বই দেয় না দফতর। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা নার্সিংহোমগুলির কার্যকলাপ নিয়ে এর আগে অনেকেই সতর্ক করেছেন। কিন্তু দফতরের তরফে কান দেওয়া হয়নি। ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট’-এর নিয়ম মেনে চলা তো দূর অস্ত্, কোনও কোনও নার্সিংহোম যে বেআইনি কাজকর্মের আখড়া তার সূত্র পেয়েও চুপ করে থাকা হয়েছে।
ভবিষ্যতেও যে এমন ঘটনা আর হবে না, দফতর যে সত্যিই ঠেকে শিখবে, সে সম্পর্কে নিঃসংশয় নন খোদ দফতরের কর্তাদের একাংশই।