পাড়ুই হত্যাকাণ্ড থেকে এমডি পাঠ্যক্রমে ভর্তি ইদানীং নানা বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের তোপের মুখে পড়ছে রাজ্য সরকার। এ বার তারা ধাক্কা খেল ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার ফোর্স বা এনভিএফে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির একটি মামলায়। বুধবার ওই মামলায় বিশেষ করে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবের বোধবুদ্ধিকে কটাক্ষ করেছে কোর্ট।
এনভিএফে কর্মী নিয়োগে স্বজনপোষণ হচ্ছে বলে অভিযোগ জানিয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা হয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, স্বজনপোষণ হয়েছেই। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, স্বজনপোষণের জন্য কারা দায়ী, হলফনামা দাখিল করে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকে তা জানাতে হবে। এ দিন শুনানি চলাকালীন স্বরাষ্ট্রসচিবের সেই হলফনামা পড়েন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং পড়েই ফেটে পড়েন ক্ষোভে।
বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, “স্বরাষ্ট্রসচিব কি কথা বোঝেন না? আদালতের নির্দেশ বোঝেন না? নাকি বুঝতে চান না? স্বরাষ্ট্রসচিব এমন ভাবে হলফনামা দাখিল করেছেন যে মনে হচ্ছে, উনি আদালতের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন।” তার পরেই বিচারপতি মন্তব্য করেন, এক জন আইএএস অফিসার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কাজ করলে সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এক জন আইএএস অফিসারের দায়িত্ব হল, রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ না-মেনে আইন অনুযায়ী কাজ করা।
জঙ্গলমহলে এনভিএফের অস্থায়ী পদে চাকরি চেয়ে অনেকেই আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্টে এমনই কয়েক জন প্রার্থীর অভিযোগ, তাঁদের নাম ওয়েটিং লিস্ট বা অপেক্ষমাণদের তালিকার উপর দিকে থাকলেও তাঁদের নিয়োগ করা হয়নি। অথচ ওই তালিকার নীচের দিকে নাম থাকা প্রার্থীরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন।
মামলাকারীদের আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত এবং বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন জানান, ১০ মার্চ এই মামলার শুনানিতে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ ছিল, ওই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ হয়েছে। যাঁরা ওই স্বজনপোষণের জন্য দায়ী, তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য স্বরাষ্ট্রসচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে স্বরাষ্ট্রসচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়, হলফনামা দাখিল করে এই ব্যাপারে আদালতের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ২০১১ সালে রাজ্য সরকার জঙ্গলমহল (পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর)-এর ১৮টি ব্লকে অস্থায়ী এনভিএফ-কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রশাসন ঘোষণা করে, প্রতিটি ব্লকে ২২৬ জন এনভিএফ-কর্মী নেওয়া হবে। প্রচুর দরখাস্ত জমা পড়ে। প্রতিটি ব্লকে ২২৬ জন কর্মী নেওয়ার পরেও অনেকের নাম অপেক্ষমাণদের তালিকায় থেকে যায়। কিছু দিন পরে দেখা যায়, প্রতিটি ব্লকেই বেশ কয়েক জন এনভিএফ-কর্মী কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। অপেক্ষমাণের তালিকায় থাকা পুরুলিয়ার ধনঞ্জয় গড়াই এবং বাঁকুড়ার শ্রীধর সানগিরি এনভিএফে যোগ দিতে চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত তখন এনভিএফের শীর্ষ পদাধিকারীকে নির্দেশ দেন, ওই অস্থায়ী চাকরি দেওয়ার সুযোগ থাকলে আইন মেনে প্রার্থীদের যেন তা দেওয়া হয়।
এনভিএফের শীর্ষ পদাধিকারী রাজ্যের অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরে চিঠি লিখে জানান, জঙ্গলমহলের ১৮টি ব্লকে ২০২ জন এনভিএফ-কর্মীর পদ ফাঁকা। সেই সব পদে নিয়োগের জন্য ওই দফতর তাদের তহবিল থেকে টাকা দিক। চাকরি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া দুই আবেদনকারী-সহ বেশ কিছু প্রার্থী (যাঁদের নাম ওয়েটিং লিস্টে ছিল) অস্থায়ী পদে চাকরিও পান।
ইতিমধ্যে মামলাটি চলে আসে বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসে। তিনিও নির্দেশ দেন, অপেক্ষমাণের তালিকায় নাম থাকা প্রার্থীদের ক্রম অনুযায়ী নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু রাজ্য প্রশাসন ক্রম অনুযায়ী নিয়োগ করছে না বলে অভিযোগ ওঠে। পুরুলিয়ার সুনীল প্রামাণিক, বাঁকুড়ার ভারত মাহাতো-সহ বেশ কিছু প্রার্থীর অভিযোগ, অপেক্ষমাণ-তালিকার ক্রম অনুযায়ী এনভিএফে নিয়োগ হচ্ছে না। তাই তাঁরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।
বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকে নির্দেশ দেন, আদালত যে-সব প্রশ্নের জবাব চেয়েছে, ফের হলফনামা দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তা জানাতে হবে।