ফের আদালতের তোপ, ফের বিচারপতির প্রশ্নের জবাব খুঁজে না-পেয়ে নিরুত্তর হয়ে থাকা। সব মিলিয়ে বিচারের আঙিনায় দাঁড়িয়ে আবার মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের।
এ বারের প্রসঙ্গ ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ড। তিন বছর আগের ওই ঘটনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও তাঁর পড়শি সুব্রত সেনগুপ্তকে গ্রেফতারের আইনি বৈধতা নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রশ্ন তুলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। উত্তরে সরকারপক্ষ এমন কথা বলেছে, যার পরের ধাপের ব্যাখ্যা তারাই প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চকে জুগিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে পুলিশ তথা সরকারের বিড়ম্বনাই বেড়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দুই প্রাক্তন রেলমন্ত্রী— মুকুল রায় ও দীনেশ ত্রিবেদীকে নিয়ে তৈরি একটি রঙ্গচিত্র ই-মেলে ‘ফরোয়ার্ড’ করার অভিযোগে অম্বিকেশ-সুব্রতকে গ্রেফতার করেছিল পূর্ব যাদবপুর থানা। ২০১২-র ১৩ এপ্রিলের রাতে। পরে দু’জন কোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পান। সেই ঘটনায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশন অম্বিকেশবাবুদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে সুপারিশ করে। কিন্তু সরকার সুপারিশ মানেনি। যে কারণে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন অম্বিকেশবাবু। তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে গত ১২ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত নির্দেশ দিয়েছিলেন, এক মাসের মধ্যে অম্বিকেশ-সুব্রতকে মোট দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দিতে হবে।
সরকার তা-ও মানেনি। বরং দত্ত-এজলাসের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে তারা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে আপিল-মামলা করেছে। এ দিন প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর আদালতে তারই শুনানি ছিল। সেখানে অম্বিকেশদের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রাজ্যের অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল লক্ষ্মী গুপ্ত দাবি করেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই সেই রাতে দু’জনকে ‘নিরাপদ হেফাজতে’ নিয়েছিল পুলিশ।
এ হেন যুক্তি অবশ্য পত্রপাঠ নস্যাৎ করে দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। এবং জানতে চায়, নিরাপত্তার স্বার্থে হেফাজতে নেওয়া হয়ে থাকলে ওঁদের কেন জামিন নিয়ে বেরোতে হল? ‘‘নিরাপত্তার খাতিরে হেফাজতে (প্রোটেকটিভ কাস্টডি) নেওয়া হলে জামিনের দরকার পড়ে কি?’’— প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি বাগচী।
সরকারপক্ষ কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। ওদের নীরবতার মধ্যেই একের পর এক ধেয়ে আসতে থাকে আদালতের প্রশ্নবাণ। ‘‘কী এমন ঘটল যে, দু’জনকে একেবারে গ্রেফতার করতে হল?’’— সরকারি কৌঁসুলিকে জিজ্ঞাসা করেন প্রধান বিচারপতি চেল্লুর। এ-ও জানতে চান, ওই কার্টুন ‘ফরোয়ার্ড’ করাটাকে পুলিশ কি সত্যিই বিরাট মাপের অপরাধ বলে মনে করে? বিচারপতি বাগচীর প্রশ্ন— নিরাপদ হেফাজতে নেওয়ার পরেও দু’জনকে গ্রেফতার করা হল কোন যুক্তিতে?
বস্তুত এ প্রসঙ্গে বেঞ্চ নিজের পর্যবেক্ষণ পরিষ্কার করে দিয়েছে। প্রধান বিচারপতির মতে, নিরাপদ হেফাজত আর গ্রেফতার, দু’টো আলাদা জিনিস। দরকার পড়লে অম্বিকেশবাবুদের গৃহবন্দি করে রাখা যেত। ‘‘কোনও মেয়েকে উদ্ধার করা হলে তাঁকে আপনারা গ্রেফতার করেন, নাকি নিরাপদ হেফাজতে রাখেন?’’— লক্ষ্মীবাবুকে উদ্দেশ করে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।
অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেলের কাছে তেমন স্পষ্ট জবাব ছিল না। মাঝে তিনি পুলিশের কাজের সমর্থনে কিছু বলতে চাইলেও কোর্টে তা ধোপে টেকেনি। যেমন লক্ষ্মীবাবু প্রশ্ন করেন, ‘‘অম্বিকেশবাবুরাই বা কেন সেই রাতে থানায় বললেন না যে, তাঁদের গ্রেফতার করা ঠিক হচ্ছে না?’’
শুনে আদালত বিস্ময় প্রকাশ করে। ‘‘আইন-কানুন সম্পর্কে কোনও সাধারণ মানুষ এত কিছু জানেন না।’’— বলেন প্রধান বিচারপতি। অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেলের কথা শুনে আইনজীবীদের অনেকেও বিস্ময় লুকোননি। তাঁদের অনেকে বলছেন, ‘‘পুলিশ আইন ভেঙে কাউকে ধরবে, আর তিনি পুলিশকে আইন শেখাবেন, এমনটা হয় নাকি? তা হলে তো ধরে নিতে হবে, কলকাতা পুলিশ আইন না-জেনেই কাজ করছে!’’
ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটার কী হল?
এ দিন হাইকোর্ট জানিয়েছে, এ সম্পর্কে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন যে রিপোর্টটি দিয়েছে, তা সরকারের তরফে দু’সপ্তাহের মধ্যে আদালতে পেশ করা চাই। তার পরে ফের শুনানি হবে।