হঠাৎ অঘোষিত বন্ধে জনজীবন বিপর্যস্ত দার্জিলিঙে।
গরমের ছুটিতে সাত সকালে শৈলশহরের কেভেন্টার্সে বসে ঐতিহাসিক ক্লক টাওয়ারে চোখ রেখে ‘সসেজ আর সালামি’ দিয়ে প্রাতরাশের পরিকল্পনা ছিল বর্ধমানের বিশ্বাস পরিবারের। শনিবার দুপুরে তাঁরা নিশ্চিন্তে পাহাড়ে পৌঁছন। সন্ধ্যা নাগাদ হোটেলের লবির আড্ডায় শোনেন পাহাড়ে বন্ধ ডেকে পোস্টার পড়েছে। কিন্তু মোর্চার তরফে বন্ধের কোনও ঘোষণা না হওয়ায়, বিষয়টিকে খুব একটা আর আমল দেননি।
কিন্তু রবিবার ভোর ভোর উঠে তৈরি হয়ে হোটেল থেকে বার হওয়ার মুখেই ওই পরিবারের কর্তা তপন বিশ্বাসকে হোটেলকর্মীরা জানিয়ে দেন, দার্জিলিঙে অঘোষিত বন্ধ শুরু হয়েছে। কেভেন্টার্স কেন, গ্লেনারিজ, সিসিডি-র মতো শহরের সমস্ত দোকানপাটই বন্ধ। অগত্যা ছেলেমেয়েকে বুঝিয়ে হোটেলেই ব্রেকফাস্ট সেরে দিনভর ম্যাল চৌরাস্তায় ঘুরে বেড়ান তাঁরা।
হাওড়ার বাসিন্দা মালবিকা রায় আবার শনিবার রাতে ক্লাব সাইড রোডের একটি দোকানে শীতের কিছু পোশাক পছন্দ করে রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন, রবিবার সকালে বেরিয়ে কিনে আনবেন। হতাশ মালবিকাদেবীর আজ, সোমবার সকালে শিলিগুড়ি নেমে আসার কথা।
অনেকে এই শৈল শহর ছেড়ে চলে গিয়েছেন গ্যাংটক।
রবিবার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার অঘোষিত বন্ধের জেরে এদিন সকাল থেকেই এমনই থমথমে ছিল পাহাড়। সকালে কিছু দোকানপাট খুললেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ছুটির দিনে বাসিন্দারা বাড়িতে বসে সময় কাটালেও বহু পর্যটক অনিশ্চয়তায় ভুগতে শুরু করেছেন। আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই শিলিগুড়িতেও নেমে আসেন। আবার কেউ কেউ সিকিম বা ডুয়ার্সে চলে গিয়েছেন। দুপুরে মোর্চার তরফে ঘোষণা করা হয়, পাহাড়ে বন্ধ হবে না। তবে গরমের পাহাড়ে ঢল নামা পর্যটকদের উদ্বেগ কাটেনি।
এ দিন শিলিগুড়ি জংশন এলাকা থেকে পাহাড়গামী ভাড়ার জিপ এবং ছোট গাড়িগুলির বড় অংশ চলাচল না করায় পর্যটকেরা সমস্যায় পড়েন। তাঁদের অনেকেই পাহাড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা শিকেয় তুলে ডুয়ার্স, সিকিম চলে যান। কেউ কেউ গাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিঙে পৌঁছন। বেলা বাড়তেই পাহাড়ে বহু রাস্তায় পুলিশি টহল অবশ্য দেখা গিয়েছে। সিআরপিএফ জওয়ানদেরও ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে। কলকাতার বাসিন্দা পিনাকি বসু, উজ্জ্বল দাস জানান, তিন দিন থাকবেন বলে তাঁরা দার্জিলিং গিয়েছেন। হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে তাঁরা উদ্বিগ্ন। দোকানপাট বন্ধ থাকায় সমস্যা বেড়েছে। চৌরাস্তা চা’ও মেলেনি। উজ্জ্বলবাবু বলেন, ‘‘তেমন হলে সমতলে নেমে যেতে হবে।’’
এরমধ্যে পর্যটন মরসুমের কথা মাথায় রেখে দার্জিলিংকে শান্ত, স্বাভাবিক রাখার আবেদন করেছেন মোর্চা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। আর তা দেখার জন্য জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কাছেও তাঁরা আবেদন করেছেন। গোর্খা লিগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি বলেছেন, ‘‘আমরা চাই পাহাড় সব সময় শান্ত থাকুক। ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে মানুষের ঢল নামুক। এতে তো এলাকায় অর্থনীতিও জড়িত।’’ এই প্রসঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি বলেন, ‘‘পাহাড় পুরোপুরি শান্ত রয়েছে। আইন শৃঙ্খলার কোথাও কোনও সমস্যা হয়নি। পর্যটকেরা নিরাপদে ঘোরাঘুরি করতে পারেন।’’
কেউ নেমে এসেছেন শিলিগুড়িতে।
মদন তামাঙ্গ হত্যা মামলায় মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ সহ বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় পর্যটন ব্যবসায়ীরাও ভেবেছিলেন, পাহাড়ে ফের আন্দোলন শুরু হলে তাঁদের ব্যবসা মার খাবে। তবে এ দিন মোর্চার তরফে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনও আন্দোলন হচ্ছে না। তবে এদিন আচমকা দোকান-পাট বন্ধ থাকায় পর্যটন ব্যবসায় কিছুটা যে তাল কেটেছে তা তাঁরা স্বীকার করছেন। ইস্টার্ন হিমালয় ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘‘এ দিন অঘোষিত বন্ধ থাকায় পর্যটকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।’’ তিনিও জানান, অনেক পর্যটক সমতলে নেমে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আশা, পাহাড় স্বাভাবিক থাকবে।’’ একই আশা করেছেন পাহাড়ের ট্যুর অপারেটররাও। তাঁদেরই একজন প্রদীপ লামা জানিয়েছেন, দিনভর বিস্তর খোঁজখবর চললেও এখনও বুকিং বাতিলের ঘটনা ঘটেনি।
দার্জিলিঙের ম্যাল লাগোয়া হোটেলের কর্মী নরবু লেপচা জানান, তাঁদের হোটেলে ৪৬টি ঘর রয়েছে। প্রতিটিই এখন ভর্তি। তবে ছয়টি দল আতঙ্কিত হয়ে, এ দিন শিলিগুড়ি নেমে গিয়েছে। তাঁদের একদিন পরে যাওয়ার কথা ছিল। চকবাজার এলাকায় হুগলির বাসিন্দা কাশীনাথ দাস বলেন, ‘‘রাতারাতি পাহাড় ছাড়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। তাই ঝুঁকি নিইনি। অসম্পূর্ণ রইল শৈলশহর সফর।’’
ছবি রবিন রাই ও বিশ্বরূপ বসাক।