Caste Census

জাতগণনায় সায় দিয়েছে মোদী সরকার, কী প্রভাব পড়তে পারে ২০২৬-এ বাংলার বিধানসভা ভোটে, প্রশ্ন বাস্তবায়ন নিয়েও

সাধারণ জনগণনায় তফসিলি জাতি (এসসি), উপজাতি (এসটি) অংশের মানুষের সংখ্যা, শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক ও জীবনধারণের মান কেমন, এ বিষয়ে সার্বিক একটা ‘ছবি’ পাওয়া যায়। কিন্তু ওবিসির বিষয়টি সাধারণ জনগণনায় থাকে না। সে কারণেই গত কয়েক বছর ধরে জাতগণনার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২৫ ০৯:০২
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

২০২৫ সালে দেশের জনসংখ্যা কত? জানেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়‌ং! জানেন না, কারণ, গত ১৪ বছর ধরে দেশে জনগণনা হয়নি। শেষ বার হয়েছিল ২০১১ সালে। নিয়মানুযায়ী (১০ বছর পরে) হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। কিন্তু কোভিডের কারণে তা থমকে যায়। বুধবার খানিকটা আচমকাই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়, এ বার জনগণনার সঙ্গে হবে জাতগণনাও (কাস্ট সেনসাস)। যে দাবি এত দিন তুলে এসেছেন রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, এমকে স্ট্যালিন, অখিলেশ যাদবেরা, তাতেই সিলমোহর দিয়েছে কেন্দ্র।

Advertisement

‘কৃতিত্ব’ নিয়ে ইতিমধ্যেই তরজা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে কৌতূহলও। চলতি বছরের শেষে বিহারে বিধানসভা ভোট রয়েছে। বছর ঘুরলে বাংলা, অসম এবং কেরলেও বিধানসভা ভোট। কৌতূহল— জাতগণনার সিদ্ধান্তের কতটা প্রভাব পড়তে পারে বাংলার ভোটে?

বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির বৈঠকের শেষে দেশের রেল ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন, এ বার একসঙ্গে জনগণনা এবং জাতগণনা হবে। কিন্তু কবে হবে, সে ব্যাপারে কোনও সময়সীমার কথা বলেননি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তার ফলেই প্রশ্ন উঠছে, ‘ভোটমুখী’ রাজ্যগুলির দিকে তাকিয়েই কি ওই ঘোষণা? জাতগণনার মূল ক্ষেত্র অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি)। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে যা গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

সাধারণ জনগণনায় তফসিলি জাতি (এসসি), উপজাতি (এসটি) অংশের মানুষের সংখ্যা, শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক ও জীবনধারণের মান কেমন, এ বিষয়ে সার্বিক একটা ‘ছবি’ পাওয়া যায়। কিন্তু ওবিসির বিষয়টি সাধারণ জনগণনায় থাকে না। সে কারণেই গত কয়েক বছর ধরে জাতগণনার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনীর বক্তব্য, ‘‘কিছু রাজ্য জাতিগত তথ্যসংগ্রহের জন্য সমীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এক একটি রাজ্যে এক এক ভাবে সমীক্ষা হয়েছে। কোনও অভিন্ন প্রক্রিয়া মানা হয়নি।’’ অশ্বিনীর দাবি, কিছু রাজ্য এই সমীক্ষা ভাল ভাবে করলেও বাকি রাজ্যগুলির সমীক্ষায় ‘অস্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ রয়ে গিয়েছে। এর ফলে সমীক্ষাগুলি ঘিরে সমাজে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। রাজনীতির কারণে যাতে সমাজের শৃঙ্খলায় কোনও প্রভাব না-পড়ে, সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত।

বাংলাতেও ওবিসির সংখ্যা নেহাত কম নয়। আবার এমন অনেক পদবির মানুষ রয়েছেন, সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী মনে করে, তাঁরাও ওবিসিভুক্ত হওয়ার যোগ্য। বারংবার আলোচনায় আসে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের কথাও। বঙ্গ রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের অনেকেই ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করছেন। তৃণমূলের ইস্তাহার প্রকাশের সময় মমতা জানিয়েছিলেন মাহিষ্য, তিলি, তামুল এবং সাহাদের ওবিসি তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেবে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার। ক্ষমতায় এসে সেই সংক্রান্ত প্রস্তাবও মন্ত্রিসভায় পাশ করিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু এখানে কেন্দ্রেরও ভূমিকা থাকে। ফলে সবটা যে বাস্তবায়িত হয়েছে তা নয়।

আবার এর সঙ্গেই জুড়ে যাচ্ছে ওবিসি শংসাপত্র নিয়ে মমতার সরকারের উপর ইতিমধ্যেই আদালতের নির্দেশে ‘চাপ’ তৈরির প্রসঙ্গ। ‘পদ্ধতিগত ভ্রান্তি’র কারণে কলকাতা হাই কোর্ট প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করে দিয়েছে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য। রাজ্যের তরফে নতুন সমীক্ষার জন্য তিন মাস সময় চাওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের কাছে। আগামী জুলাই মাসে সেই মামলার পরবর্তী শুনানি। এরই মধ্যে কেন্দ্রের এই ঘোষণা রাজ্যের উপর বাড়তি ‘চাপ’ তৈরি করতে পারে বলে অনেকের অভিমত। আনুষ্ঠানিক ভাবে অবশ্য তৃণমূল বিষয়টিকে ‘চাপ’ বলে মানছে না। বরং বাংলার শাসকদল কেন্দ্রের জাতগণনার সিদ্ধান্তকে ‘ভোটের অস্ত্র’ হিসাবেই দেখতে এবং দেখাতে চাইছে। রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ প্রকাশ চিক বরাইকের যেমন বক্তব্য, ‘‘বিজেপি ভোটের বৈতরণি পার হওয়ার জন্যই এ সব ঘোষণা করেছে। এগুলো সবই নির্বাচনী চমক।’’ পাল্টা আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ মনোজ টিগ্গা বলেছেন, ‘‘পিছিয়ে-পড়া অংশকে এগিয়ে আনার লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার চলছে। সেটাই মোদীজির দর্শন। জাতগণনা অনেক বড় কর্মসূচি। তৃণমূল এ সব নিয়ে যত কম বলে, তত ভাল।’’

২০১১ সালের জনগণনায় যুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এক অবসরপ্রাপ্ত আমলা বলছেন, ‘‘জাতগণনা শুরু হয়ে গেলে এক রকমের রাজনীতি হতে পারে। শুরু না-হলে ভিন্ন রাজনীতি হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তবে এই ঘোষণা নিয়ে যে নির্বাচনী রাজনীতি হবে, তা বলাই বাহুল্য।’’ ওই অবসরপ্রাপ্ত আমলা এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, স্বাধীনতার পরে কখনও দেশে জাতগণনা হয়নি। ফলে সরকারের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। সে দিক থেকে প্রক্রিয়ায় ‘ত্রুটি’ থাকার অবকাশ রয়েছে। বাংলায় বর্তমান রাজনীতির যে বিন্যাস, তাতে বিজেপি এবং তৃণমূল জাতগণনাকে দু’ভাবে ‘হাতিয়ার’ করতে পারে। মতুয়া, রাজবংশী মহল্লায় বিজেপি তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে গত লোকসভা ভোটে (যদিও কোচবিহার আসন হারাতে হয়েছে বিজেপি-কে)। আবার পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী মহল্লায় বিজেপি যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, গত লোকসভায় তাতে ভাঙন ধরিয়েছে তৃণমূল। ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার মতো আসন জিতেছে জোড়াফুল। আমলা থেকে রাজনীতিক— প্রায় সকলেই মানছেন, জাতগণনার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে তুলে ধরে বিজেপি অনগ্রসর শ্রেণিকে কাছে টানতে চাইবে। আবার জাতগণনার প্রক্রিয়া শুরু হলে তৃণমূল সেটিকে সার্বিক ভাবে বিরোধীদের দাবি বলে তুলে ধরবে। আর না হলে তৃণমূলের সামনে সুযোগ থাকবে এটিকে ‘ফের একটি জুমলা’ বলে দেগে দেওয়ার।

সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চের নেতা তথা প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ অলকেশ দাসের কথায়, ‘‘ওবিসিদের বিষয়ে যত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পাওয়া যাবে, তত সত্য প্রকট হবে। বিহার প্রমাণ করে দিয়েছে, পুরনো ধারণা আর বর্তমানের বাস্তবতা এক নয়।’’ বিহারে নীতীশ কুমার যখন আরজেডির সঙ্গে সরকার চালাচ্ছিলেন, তখনই জাতগত সমীক্ষা করিয়েছিলেন। তার পরে তামিলনাড়ু, কর্নাটকেও এই ধরনের সমীক্ষা হয়েছে। প্রায় সব সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছে, ওবিসি অংশ সম্পর্কে বাস্তব তথ্য-পরিসংখ্যান সরকারের কাছে ছিল না। তার পরেই সারা দেশে সমীক্ষা করানোর দাবি জোরালো হতে শুরু করে। তবে বাংলার বর্তমান রাজনীতি যে ভাবে ‘ধর্মীয় মেরুকরণে’ আটকে রয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করিয়ে দিয়েই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত রায় বলছেন, ‘‘জাতগণনা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জাতিহিংসার ভয়াবহ ইতিহাস এ দেশে রয়েছে। ফলে বিষয়টি স্পর্শকাতর। তা যেন সকলেই মাথায় রাখেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement