ভূতনাথ মালিক। ছবি: সুব্রত জানা।
আমার ৩৬ বছরের জীবনে এত জল দেখিনি।
এত দিন জানতাম, অতিবৃষ্টিতে দামোদরের পশ্চিম দিকে থলিয়া, বিকেবাটি, শিয়াগ়ড় প্রভৃতি গ্রামে বন্যা হয়। ডিভিসি জল ছাড়লেই ওই গ্রামগুলি বন্যায় ডোবে। আমাদের বাস দামোদরের পূর্ব পাড়ে আমতা-১ ব্লকের রসপুর পঞ্চায়েতের বলাইমাঝি গ্রামে। এখানে বাঁধ শক্তপোক্ত ভাবে বাঁধা। নিচু এলাকা। প্রতি বছর বৃষ্টির জল জমে যায়। কিন্তু এ বারের মতো পরিস্থিতি কোনও দিন দেখিনি।
দিন কয়েকের টানা বৃষ্টিতে খাল-বিল ভরিয়ে জল উঠল বাড়ির উঠোনে। তারপর ভাসল মেঝে। দিন আনি, দিন খাই। পেশায় দিনমজুর। ছিটেবেড়ার মাটির বাড়ি। একটা থাকার ঘর এবং রান্নাঘর। সম্বল বলতে একটি তক্তাপোষ, কিছু বিছানাপত্র, বাসন, স্বামী-স্ত্রীর রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড আর একটি ছাগল। ঘর যখন জলে থইথই, তখন ছাগলটিকে বাড়ির পাশে একটি উঁচু ঢিবিতে গাছের সঙ্গে বেঁধে স্বামী-স্ত্রী মিলে দিন পাঁচেক আগে বলাইমাঝি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ত্রাণ শিবিরে গিয়ে উঠলাম। সারা দিনে কাজ বলতে, দিনেরবেলা জল ভেঙে ছাগলটিকে গাছের পাতা খাইয়ে আসা।
আমতার রসপুরে বলাই মাঝি প্রাইমারি স্কুলে ত্রাণের খিচুড়ি বিলি। ছবি: সুব্রত জানা।
ত্রাণ শিবিরে এর আগে কোনও দিন থাকতে হয়নি। এখানে কোনও মতে বিদ্যুৎ নিয়ে দু’টি বাল্ব জ্বালানো হচ্ছে। তাও বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। রাতে লম্ফ জ্বালিয়ে কোনও মতে রাত কাটাতে হচ্ছে। অন্তত ৪০ জন মহিলা-সহ এখানে আমরা প্রায় ৩০০ জন রয়েছি। সকালের খাবার কিছুই নেই। দুপুরে খিচুরি দেওয়া হচ্ছে। রাতে মুড়ি, বিস্কুট। স্কুলের শৌচাগারটি তালা মারা। শৌচকর্ম করতে মেয়েরা সমস্যায় পড়ছেন। আমার স্ত্রীকে জল ভেঙে নদীর বাঁধে গিয়ে শৌচকর্ম করতে হচ্ছে।
তিল তিল করে টাকা জমিয়ে মাটির বাড়িটি তৈরি করেছিলাম। ত্রাণ শিবির ছেড়ে আবার বাড়ি কবে যেতে পারব, কে জানে! বাড়ি কি আর আস্ত থাকবে? পঞ্চায়েতের কাছে একটা ত্রিপল চেয়েছি। খুঁটিতে ত্রিপল টাঙিয়ে কিছু দিন হয়তো চলবে। তারপর? গাঁটের কড়ি খরচ করে যে বাড়ি করব সে টাকা আমার কাছে নেই। নিরাশ্রয় হওয়ার দুঃস্বপ্ন আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।