সুনসান: চেয়ার-টেবিল উল্টে রাখা চুঁচুড়া আদালত চত্বরে। নিজস্ব চিত্র
বৈঁচি গ্রামের মোস্তাকিরা খাতুনের বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা চলছে। খোরপোশের টাকার জন্য তাঁকে রোজই চুঁচুড়া আদালতে আসতে হচ্ছে। কিন্তু ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। কারণ, এক মাস ধরে আদালত বন্ধ। মোস্তাকিরার কথায়, ‘‘যে টাকা পাব, তার দ্বিগুণ টাকা শুধু যাতায়াতেই খরচ হয়ে গেল।’’
ধনেখালির দশঘড়ার বাসিন্দা অমল মজুমদার নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দ্রুত নতুন ফ্ল্যাটে আসতে চান তিনি। তাই ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের জন্য ছোটাছুটি করছেন এক মাস ধরে। সেই কাজও থমকে।
পোলবার মইনুল হক পারিবারিক জমিজমা নিয়ে মামলা চলছে বহু বছর ধরে। হাজিরার জন্য প্রায়ই আসেন আদালতে। কিন্তু কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। তাই ফিরে যেতে হচ্ছে বারবার।
গত এক মাস ধরে এমনই নানা ঘটনার সাক্ষী চুঁচুড়া জেলা আদালত।
বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে গত ২২ মে থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন চুঁচুড়া জেলা আদালতের আইনজীবীরা। একে সমর্থন জানিয়ে আদালতকর্মীরাও কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। ফলে মামলা-সহ সমস্ত কাজই বন্ধ গত এক মাস ধরে। কর্মবিরতির আঁচ পড়েছে আদালতের রেজিস্ট্রি দফতরেও। জমি বাড়ি কেনাবেচা সংক্রান্ত সমস্ত কাজও বন্ধ রয়েছে। সমস্যায় পড়েছেন সাধারণ বিচারপ্রার্থী থেকে শুরু করে জেল কর্তৃপক্ষও।
বন্ধ রয়েছে আদালত চত্বরের দোকানপাটও। নিজস্ব চিত্র।
আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, চুঁচুড়ার জেলা আদালত ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে। আদালতে আইনজীবীদের কাজ করার জায়গা হয় না। আইনজীবীদের অভিযোগ, জেলা প্রশাসনের নতুন ভবন তৈরি হওয়া সত্বেও বেশ কিছু দফতর এখনও পুরনো আদালত ভবনে রয়ে গিয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য জেলার অন্যত্র নতুন ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। কিন্তু আইনজীবীদের দাবি, চুঁচুড়া জেলা সদর থেকে এই আদালত অন্যত্র সরানো যাবে না। তাঁদের অভিযোগ, জেলা সদরের কেন্দ্রস্থল থেকে আদালত সরানো হলে কাজে সমস্যা হবে। ফলে বিপাকে পড়বেন সাধারণ মানুষ। এরপরই শুরু কর্মবিরতি।
এই কর্মবিরতির জেরে সমস্যা পড়েছেন আদালতে আসা বহু মানুষ। পান্ডুয়ার সিমলাগড়ের বাসিন্দা শেফালি বসু বলেন, ‘‘স্বামীর বিরুদ্ধে খোরপোষের মামলা করে মাসে মাসে আদালতের মাধ্যমে সেই টাকা পাই। কিন্তু এই কর্মবিরতির জেরে টাকা পাচ্ছি না। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ মেটাতে পারছি না।’’
সমস্যায় পড়েছে জেল কর্তৃপক্ষও। আদালতে বিচার না হওয়ায় জেল হেফাজতে থাকা বন্দির সংখ্যা বাড়ছে। ফলে জেলে তাঁদের স্থান সঙ্কুলানও হচ্ছে না বলে অভিযোগ। জেলে পুরুষ, মহিলা-সহ মোট ৪৪৪ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এখন সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮০ তে। তাছাড়া বিভিন্ন অসামাজিক কাজে যুক্ত বিচারাধীন বন্দিদের সাথে সাধারণ বিচারাধীন বন্দিদের থাকায় সুরক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
এক মাস ধরে আদালত বন্ধ থাকার ফলে যেমন সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়ছেন তেমনই সমস্যায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আদালতের সামনেই হোটেল এক মহিলার। তাঁর কথায়, ‘‘আদালতের উপর নির্ভর করেই আমাদের এই ব্যবসা। তাই লাটে উঠেছে ব্যবসা।’’
চুঁচুড়া আদালতের এক প্রবীণ আইনজীবীর কথায়, ‘‘এই আদালত ভবনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে আদালত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে সকলের সমস্যা হবে। এই শহরের বুকেই নতুন আদালত ভবন তৈরি প্রয়োজন।’’ কিন্তু তার জন্য এক মাস ধরে আন্দোলন? আর কাজ বন্ধ? কোনও সদুত্তর মেলেনি। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার অবশ্য সাফাই, ‘‘আইনজীবীদের কর্মবিরতিতে সমস্যা হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।’’