মাটি-মাফিয়াদের বাড়বাড়ন্তে ক্ষোভ চাষিদের

চণ্ডীতলা জুড়ে দেদার কোপ কৃষিজমিতে

নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না-করে বড় বড় যন্ত্র এনে দিনভর কৃষিজমি থেকে মাটি কাটা চলছে। তার পরে ডাম্পার বোঝাই হয়ে তা চলে যাচ্ছে ইটভাটা বা নিচু জমি ভরাটের কাজে। বিঘার পর বিঘা কৃষিজমিতে বন্ধ হচ্ছে চাষ। ক্ষোভ বাড়ছে চাষির। কিন্তু মাটি-মাফিয়াদের লাগাম পরাবে কে? 

Advertisement

প্রকাশ পাল ও দীপঙ্কর দে

চণ্ডীতল‌া শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০৩:১৬
Share:

কৃষিজমি যেন মাটি-মাফিয়াদের মৃগয়াক্ষেত্র!

Advertisement

নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না-করে বড় বড় যন্ত্র এনে দিনভর কৃষিজমি থেকে মাটি কাটা চলছে। তার পরে ডাম্পার বোঝাই হয়ে তা চলে যাচ্ছে ইটভাটা বা নিচু জমি ভরাটের কাজে। বিঘার পর বিঘা কৃষিজমিতে বন্ধ হচ্ছে চাষ। ক্ষোভ বাড়ছে চাষির। কিন্তু মাটি-মাফিয়াদের লাগাম পরাবে কে?

এ ছবি হুগলির চণ্ডীতলার। ভুক্তভোগী চাষিদের অভিযোগ, পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনেই কৃষিজমির মাটি সাফ হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানালেও সুরাহা মেলেনি। সম্প্রতি চণ্ডীত‌লা-১ ব্লকে এই কারবারের বিরুদ্ধে চাষিরা ক্ষোভ উগরে দেন। চণ্ডীতলা-২ ব্লকের জেলা পরিষদ সদস্যের মুখেও উঠে এসেছে একই অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারির পরেও মাটি-কারবারিরা এত সাহস কোথা থেকে পায়, এ প্রশ্নও উঠছে।

Advertisement

চণ্ডীতলা-১ ব্লকের কৃষ্ণরামপুর এলাকার চাষি সুরজিৎ কোলের অভিযোগ, ‘‘মাটি ব্যবসায়ীদের চক্র জমির চরিত্র বদলে দিচ্ছে। গত বছর আমাদের এখানকার এক চাষি জমি ওই ব্যবসায়ীদের কাছেই বেচে দিলেন। কারণ, পাশের জমি থেকে গভীর ভাবে মাটি কেটে নেওয়ায় তাঁর জমিতে ধস নেমেছিল। চাষ করা সম্ভব ছিল না। এর পরে তাঁর জমি থেকেও মাটি কাটা হল।’’ মশাট বাজার এলাকার এক চাষি জানান, স্থানীয় আশ্রমধারে তাঁর জমি রয়েছে। দু’বছর আগে একদিন সকালে গিয়ে তিনি দেখেন, জমির একাংশে গভীর করে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। মাটি কাটার যন্ত্র আর ডাম্পারের চাকায় জমির বাকি অংশ এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘ওখানে ধান চাষ করতাম। এক রাতেই পুরো খেতটা ওরা নষ্ট করে দেয়। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলাম। কিচ্ছু হয়নি। ওই জমিতে আর চাষ করতে পারি না।’’

ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, নিয়ম না-মেনে যথেচ্ছ মাটি কাটলে ভূগর্ভের ভারসাম্য নষ্ট হয়। বেআইনি এই কাজের জন্য জেল-জরিমানার শাস্তি রয়েছে। কিন্তু তাতেও চণ্ডীতলার পরিস্থিতি বদলায় না। অভিযোগ, চণ্ডীতলা-১ ব্লকের আঁইয়া, মুকুন্দপুর, বনমালীপুর, কৃষ্ণরামপুর, ভগবতীপুর, গণেশপুর, নবাবপুর, চণ্ডীতলা-২ ব্লকের কলাছড়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় মাটি কাটার রমরমা কারবার চলে। খাসজমির মাটিও দেদার কাটা হয়। প্রতি দিন অন্তত দু’শো ডাম্পার মাটি কাটা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, অহল্যাবাই রোড ধরে ‌ওই মাটি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে নিচু জমি ভরাটের কাজে নিয়ে যাওয়া হয়। নানা ইটভাটাতেও বিক্রি হয়। প্রতি দিন লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন হয়। কৃষিজমি থেকে মাটি কাটার অভিযোগে সম্প্রতি চণ্ডীতলা-১ ব্লকে প্রশাসনিক দফতরের সামনে গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখান। মাটি-কারবারিদের ছাউনি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ব্লক ভূমি দফতরে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, ডাম্পার চলাচলের কারণেও জমির দফারফা হচ্ছে। বনমালীপুরের এক চাষির কথায়, ‘‘আমার পাশের জমি থেকে গভীর গর্ত করে মাটি কাটা হয়েছে। বর্ষার পরে আমার জমি ধসে যাবে। ওরা মাটি বিক্রি করে টাকা উপার্জন করছে। আমাদের শেষ করে দিচ্ছে।’’

বিএলএলআরও (চণ্ডীতলা-১) স্মৃতিকণা পাল বলেন, ‘‘কৃষিজমি থেকে মাটি কাটা বেআইনি। অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ চাষিদের বিক্ষোভের পরে ব্লক ভূমি দফতর এবং পুলিশ কৃষ্ণরামপুরে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি ডাম্পার আটক করে। পাঁচ জন ডাম্পার-চালককে গ্রেফতার করা হয়। বিএলএলআরও চণ্ডীতলা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। চাষিদের অভিযোগ, তাতেও পরিস্থিতি বদলায়নি। এখন দিনের পরিবর্তে রাতে মাটি কাটা হচ্ছে। তবে বৃষ্টির জন্য কয়েক দিন কাজ বন্ধ রয়েছে।

মাটিবোঝাই ডাম্পার চলাচলের ফলে অহল্যাবাই রোডে প্রবল যানজট হচ্ছে, এই অভিযোগে কিছুদিন আগে চণ্ডীতলা-২ বিএলএলআরও দফতর এবং থানায় লিখিত অভিযোগ জমা দেন জেলা পরিষদের সদস্য তৃণমূলের অনিন্দিতা মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘মাটি কাটা নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে কটু কথা শুনছি। যারা এই অবৈধ কাজে যুক্ত, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক প্রশাসন।’’ বিডিও কৃষ্ণচন্দ্র মুন্ডা জানান, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

কিন্তু ব্যবস্থা নিতে যত দেরি হবে, তত চাষের এবং কৃষিজমির ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন চাষিরা। তাঁদের প্রশ্ন, সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন