হুগলির একটি ত্রাণশিবিরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। ছবি: দীপঙ্কর দে।
সকাল থেকে বৃষ্টি বন্ধ হলেও রবিবার ডিভিসি জল ছাড়া শুরু করেছে। ফলে, দুই জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি তো হলই না, বানভাসি মানুষদের বিপত্তি আরও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
হুগলিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আরামবাগ মহকুমার দামোদর, মুণ্ডেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর এবং রূপনারায়ণ— চারটি নদীই এ দিন বিপদসীমা ছাড়িয়ে চূড়ান্ত বিপদসীমার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। বাঁধের নিচু এলাকা দিয়ে জল ঢুকছে লোকালয়ে। একই ভাবে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে দামোদরের জলে প্লাবিত হয়েছে ডিহিভুরসুট থেকে বকপোতা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা।
আরামবাগ এতদিন প্লাবিত হয়েছিল বৃষ্টির জলেই। রবিবার সকাল থেকে ডিভিসি-র ছাড়া ৭০ হাজার কিউসেক জল দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরী নদীতে এবং বাঁকুড়া ক্যাচমেন্ট বেসিন থেকে ৩৯ হাজার কিউসেক জল দ্বারকেশ্বর নদী দিয়ে বইছে। আরামবাগে দামোদরের ক্ষেত্রে বিপদসীমা ১৩.৩৮ মিটার। চরম বিপদসীমা ১৩.৫০ মিটার। এ দিন দুপুরে সেখানে জল বইছে প্রায় ১৩.৪৮ মিটারে। মুণ্ডেশ্বরীর বিপদসীমা ১২.১৯ মিটার। আর চরম বিপদসীমা ১৩.৪১ মিটার। সেখান দিয়ে বিকেলে জল বইতে থাকে ১৩.৩০ মিটারের বেশি উচ্চতা দিয়ে। আবার দ্বারকেশ্বর নদী শেখপুরে প্রায় চরম বিপদসীমা (১২.৩৪) ছুঁয়ে বইছে। বর্তমানে সেখানে জলের উচ্চতা ১২.৩ মিটার।
মহকুমাশাসক প্রতুলকুমার বসু জানান, চারটি নদী দিয়ে এখনই বিপদসীমার উপরে জল বইছে। এরপর আরও জল ছাড়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে ডিভিসি। মহকুমার নদীগুলি দিয়ে ১ লক্ষ কিউসেকের উপর জল বইবে। বন্যার আশঙ্কায় তা মোকাবিলার জন্য প্রশাসন সজাগ রয়েছে। এ দিন সন্ধ্যায় ৪২ জনের বিপর্যয় মোকাবিলা দল আরামবাগে পৌঁছয়। মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। ৩৫টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। সেখানে সকালে চিঁড়ে-গুড় এবং দুপুরে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। আরও ত্রাণের চাহিদার কথা জানানো হয়েছে জেলায়। স্বাস্থ্য, সেচ, পূর্ত-সহ সংশ্লিষ্ট সমস্ত দফতরকে যুদ্ধকালীন তত্পরতায় কাজ করতে বলা হয়েছে।’’
রবিবার ভোরেই খানাকুল-১ ব্লকের কিশোরপুর, ধান্যগড়ি, ঘোষপুর সংলগ্ন দ্বারকেশ্বর নদীর বাঁধের নিচু অংশ (হানা) টপকে জল ঢোকায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে প্রায় ৩০টি গ্রাম। ঘোড়াদহে রূপনারায়ণের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রাম। হানা এখন সংস্কারের উপায় নেই বলে জানিয়েছেন মহকুমা সেচ আধিকারিক প্রিয়ম পাল। ওই ব্লকের মাড়োখানা, বালিপুর, চিংড়া, শাবলসিংহপুর-সহ ১১ টি পঞ্চায়েতের মোট ৬৮টি গ্রামই আগেই বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মহকুমার সমস্ত জল বের হবার একমাত্র পথ খানাকুল-২ ব্লক এলাকার উপর দিয়ে। সেই জল বেরিয়ে রূপনারায়ণ নদীতে পড়ে। রূপনারায়ণ নদীতে সেই জল পড়ার জন্য নিকাশি ব্যবস্থারও অভাব নেই। কিন্তু তা নিয়মিত সংস্কার যেমন হয় না। নিকাশি-নালাও জবরদখল হয়ে গিয়েছে। অনেক জায়গায় নালা বুজিয়েও ফেলা হয়েছে। রূপনারায়ণের নাব্যতার কারণে জল নামছে না। এই বিষয়গুলি সরকার বিবেচনা করলে তবেই বন্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
জেলার হরিপাল, তারকেশ্বর, জাঙ্গিপাড়া, বলাগড়ের মতো প্লাবিত এলাকাগুলিরও এ দিন কোনও উন্নতি হয়নি। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম রবিবার ধনেখালি, জাঙ্গিপাড়া, দাদপুরের প্লাবিত এলাকাগুলি পরিদর্শন করেন। কয়েকটি ত্রাণ শিবিরেও যান। মন্ত্রী বলেন, ‘‘জমা জলটাই এখন সমস্যার। জল নেমে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।’’
অন্যদিকে, হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরেও বন্যার আশঙ্কা করছে প্রশাসন। সেচ দফতরের হিসাব অনুযায়ী রবিবার রাতে ডিভিসি এক লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে। এমনিতেই বৃষ্টির জলে মাঠঘাট ডুবে ছিল। তার উপরে ডিভিসি-র জল দামোদরের বাঁধ উপচে ডিহিভুরসুট থেকে বকপোতা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাকে প্লাবিত করেছে।
সেচ দফতরের আধিকারিকরা জানান, ডিভিসি আরও বেশি জল ছাড়লে উদয়নারায়ণপুর এবং লাগোয়া আমতা-২ ব্লকে অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতই প্লাবিত হয়ে যাবে। আমতা-১ ব্লকের রসপুর, চন্দ্রপুর, ঘোষালপুর, বসন্তপুর প্রভৃতি এলাকার জমা জল না নামায়, মানুষদের দুর্ভোগ কাটেনি। ইতিমধ্যেই এই সব এলাকায় উঁচু বাড়ি এবং প্রাথমিক স্কুলে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। সেখানে শুকনো খাবার এবং রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেডিক্যাল টিম ওই শিবিরগুলিতে যাচ্ছে। পেটের অসুখ-সহ সর্দি, কাশি ও জ্বরের ওষুধ বিলি করা হচ্ছে। পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে পানীয় জলের পাউচ।