জনপ্লাবন: সপ্তমীর রাতে চন্দননগরের একটি মণ্ডপের পথে। । নিজস্ব চিত্র
এ শহরে এখন রাতের আঁধার নেই!
শেষ হয়েছে অপেক্ষা। মুছেছে নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততা।
এক শহরে এখন হাজার ‘জগৎ’! আলোর কারিকুরিতে কত গল্প-কবিতা! সম্মোহিত কচিকাঁচা থেকে কলেজ পড়ুয়া, কিশোরী থেকে ছাপোষা গৃহবধূ। চন্দননগর এখন জগদ্ধাত্রীময়। বুধবার সপ্তমীর সকাল থেকেই রাজপথ থেকে অলিগলিতে বাঁধভাঙা জলের মতো ছড়িয়ে পড়ল ভিড়। সন্ধ্যায় মানকুণ্ডু স্টেশন রোড, তেমাথা, দৈবকপাড়া, নোনাটোলা, বারাসত গেট, দিনেমারডাঙা, মহাডাঙা, পালপাড়া, ফটকগোড়া— সব জায়গাতেই জনস্রোত।
এমনিতে ‘চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী’ বলা হলেও এই পুজো ভদ্রেশ্বর থেকে চুঁচুড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এ দিন দুপুর ১২টায় জ্যোতির মোড় চৌমাথায় কয়েকশো মানুষের ভিড়। সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রীরামপুরে অনন্যা ভট্টাচার্যের গলায় বিস্ময়, ‘‘রাতের ভিড় এড়াতে আলো দেখার মায়া ত্যাগ করে সকালে ঠাকুর দেখতে এসেছি। এখনও এত ভিড় হবে, কী করে জানব!’’
কেউ ভদ্রেশ্বর, কেউ মানকুণ্ডু স্টেশনে নেমে ঠাকুর দেখতে দেখতে চুঁচুড়ায় গিয়ে শেষ করেছেন। কেউ আবার উল্টো পথে হেঁটেছেন। সময় যত গড়িয়েছে, রাস্তায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কালো মাথার সারি। অনেকেই জানিয়েছেন, অষ্টমী-নবমীর ভিড় এড়াতে বুধবারেই ঠাকুর দেখা সেরে ফেলতে চেয়েছেন। কিন্তু সপ্তমীতেই ভিড় যে কোনও অংশে কম নয়, মানুষের চাপে তা বিলক্ষণ বোঝা গিয়েছে। তবে, চিঁড়েচ্যাপ্টা ভিড় সামলে একটার পর একটা মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে দর্শনার্থীদের মুখে বিজয়ীর হাসি। আলোর রোশনাই আর বিভিন্ন মণ্ডপের থিম দেখে সবাই মুগ্ধ। অনেকেই মণ্ডপ, প্রতিমা বা আলোর ছবি ছড়িয়ে দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভদ্রেশ্বর তেঁতুলতলা, ভদ্রেশ্বর গঞ্জের মতো বিখ্যাত পুজো মণ্ডপগুলিতেও ভিড় জমিয়েছেন কাতারে কাতারে মানুষ।
চন্দননগরের বিবিরহাট উত্তরাঞ্চলের মণ্ডপের সামনে জীর্ণ সাদা থান কাপড় ঝুলছে। মণ্ডপের ভিতরে জরাজীর্ণ, অসহায় এক বৃদ্ধা পে-লোডারের উপর বসে। পুজোর থিম— ‘মাতৃঋণ’। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে পুজোর মধ্যে দিয়ে, বক্তব্য উদ্যোক্তাদের। পালপাড়া রোড থেকে সরু গলি বেয়ে এগোলেই সুরেরপুকুর সর্বজনীন। থিম— ‘ব্লাড’। রক্তদানের নানা আঙ্গিকে বোঝানো হয়েছে— রক্তের জাত নেই। বাঁশের সাঁকোয় মণ্ডপের প্রবেশপথ যেন ‘স্কাইওয়াক’!
মন্দির, মসজিদ, গির্জার সমন্বয়ে কাঁটাপুকুর চৌমাথার মণ্ডপ যেন সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র! ছোটদের মন কাড়তে বোরো মিত্রবাগানের থিম ‘চিড়িয়াখানায় চিচিংফাঁক’। নকল বাঘ-ভাল্লুক-সিংহ-হাতির অবাধ বিচরণ। পালপাড়া সর্বজনীনের মণ্ডপ যেন আন্দামানের দ্বীপ। প্রতিটি পুজো মণ্ডপ যেন ভাবনার চমকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। জিটি রোড-সহ প্রধান রাস্তাগুলির দু’ধারে অসংখ্য খাবারের দোকান। চারটে দিন সেখানেই দিন গুজরান কর্মীদের। কোনও দোকানই ফাঁকা নেই। ‘‘সবই মা জগদ্ধাত্রীর কৃপা’’— ভিড় সামলে কোনও মতে বললেন এক চাউমিন দোকানি।
শাওলি বটতলা সর্বজনীনে অস্ত্রের সম্ভার। মানুষের আলো-আঁধারি মনকে তুলে ধরতে কুণ্ডুঘাট দালানের মণ্ডপের মাথায় সূর্যদেবতার রথ। ভিতরে অন্ধকার জগৎ। হেলাপুকুর সর্বজনীনে জন্ম থেকে মৃত্যুর কাহিনি। দৈবকপাড়ার মণ্ডপে শিবের তাণ্ডব-দৃশ্য। সাতঘাট সর্বজনীনে আফ্রিকার সেপু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন-কাহিনি। খলিসানি সর্বজনীনে মাতৃস্নেহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সব জায়গাতেই মানুষের ঢল। ভিড় সামাল দিতে হিমসিম পুজোর উদ্যোক্তারা। নিয়োগীবাগান বালক সঙ্ঘের কাছে দেখা মিলল জলপাইগুড়ির সুপর্ণা পালের। মাঝবয়সী মহিলা সপরিবারে চন্দননগরের শ্রীপল্লিতে আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছেন। বললেন, ‘‘প্রতিবারেই এখানকার জগদ্ধাত্রীর নাম শুনি। এ বার চলেই এলাম। উৎসবে এত ভিড় কোথাও দেখিনি। এ তো জনসমুদ্র!’’
‘‘বিকেল থেকেই প্রতি ঘণ্টায় ভিড় লাফিয়ে বেড়েছে। আয়োজন সার্থক।’’— বলছেন নতুনপাড়া সর্বজনীনের এক কর্মকর্তা।