ভরসা: অনলাইনে চলছে পড়াশোনা। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ
চার মাসে পুরো পাল্টে গিয়েছেন মৃণালেন্দু কোলে!
খানাকুলের রাজহাটির বছর চল্লিশের ওই যুবক পেশায় গৃহশিক্ষক। ইংরেজি পড়ান। আগে ছাত্রছাত্রীদের মোবাইলে মগ্ন থাকতে দেখলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন। এখন মৃদু ধমক দেন। লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের থেকে শিখেছেন ইন্টারনেট ব্যবহার। পথে বসার হাত থেকে বেঁচেছেন। এখন নেট-যোগেই চালাচ্ছেন টিউশন।
শুধু মৃণালেন্দুই বা কেন, আরামবাগের বহু গৃহশিক্ষককেই ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করছে ইন্টারনেট পরিষেবা। অনেকের মাসে আয় ছিল ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মার্চে লকডাউন শুরু হওয়ার পরে সকলেরই উপার্জন এক ধাক্কায় শূন্যে নেমে আসে। চোখে অন্ধকার দেখেন তাঁরা। আলো জ্বালল নেট, ব্রডব্যান্ড।
মৃণালেন্দু ২২ বছর ধরে গৃহশিক্ষকতা করেই সংসার চালান। পড়ান পঞ্চম শ্রেণি থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী ছিল প্রায় ৪০০। সারাদিনে সাতটি ‘ব্যাচ’ পড়াতেন। মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় হত। সেই টাকাতেই বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাতেন। লকডাউনের এক মাস পেরোতেই হাত খালি হয়ে যায়। বাবার ওষুধের খরচই মাসে কয়েক হাজার টাকা। পাবেন কোথায়? তখন ছাত্রছাত্রীরা আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
‘‘সংসার কী ভাবে টানব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। হাঁফিয়ে উঠছিলাম। ইন্টারনেটই পথ করে দিল। স্মার্টফোন থাকলেও নেট ব্যবহার করতাম না। মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করায় যাদের বকাবকি করতাম, তাদের কাছ থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার শিখলাম। ইউটিউব-সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় সড়গড় হলাম। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ব্রডব্যান্ড সংযোগও নিলাম। মে মাস থেকে অনলাইন ক্লাস শুরু করলাম।’’
আগের মতো অত শিক্ষার্থী পাননি। তবু, দুশ্চিন্তা মুছেছে। তাঁর কথায়, “আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ পড়ুয়াও হয়নি। সবাই বেতনও দিতে পারছে না। তবু ইন্টারনেটের কল্যাণে মাসে ১০-১২ হাজার টাকায় সংসারটা অন্তত সামলানো যাচ্ছে।’’
এ রকমই হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন গোঘাটের বেঙ্গাইয়ের বাংলার গৃহশিক্ষক সৌমিত্র রায়, আরামবাগ শহরের অঙ্কের গৃহশিক্ষক শুভেন্দু মুদি, কামারপুকুরের সংস্কৃতের গৃহশিক্ষক দীনেশ রায়রা।
সৌমিত্র অনলাইনে গৃহশিক্ষকতা শুরু করেন মে মাস থেকে। তিনি বলেন, “আগে প্রায় ৫০০-৬০০ ছাত্রছাত্রী ছিল। লকডাউনে সব বন্ধ হওয়ায় বিপদে পড়ি। অনলাইনে পড়ানো রপ্ত করি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। এখন প্রায় ৩৫০ ছাত্রছাত্রী পেয়েছি।” শুভেন্দুর কথায়, ‘‘আয় ৩০ শতাংশ কমলেও একবারে কর্মহীন, উপার্জনহীন হয়ে থাকতে হচ্ছে না। এটাই যথেষ্ট।” তিনিও ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়েছেন।
লকডাউনের পর থেকে মোবাইল বিক্রি এবং ব্রডব্যান্ড সংযোগ নেওয়া যে অনেক গুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তাঁরা মানছেন, জীবিকার প্রয়োজনেই গ্রামীণ এই মহকুমায় মানুষ এখনও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছেন। আরামবাগ শহরের ফোন ব্যবসায়ী তোতন তরফদার বলেন, “পড়াশোনার জন্য প্রায় ৮০ শতাংশ মোবাইল বিক্রি বেড়েছে। মার্চ মাস অব্দি গড়ে প্রতি মাসে বিক্রি ছিল ৩০-৩২ লক্ষ টাকার। জুন মাস থেকে ৫০ লক্ষ টাকার উপর বিক্রি হচ্ছে।’’ একটি ব্রডব্যান্ড সংযোগকারী সংস্থার আরামবাগের প্রতিনিধি শঙ্কর ভুঁইয়ার গলাতেও এক সুর, ‘‘মার্চের আগে গড়ে মাসে ৪-৬টি সংযোগ হত। এখন ২০-২২টি সংযোগ হচ্ছে।”