তারকেশ্বর

মরদ আমার মানুষ হয়েছে, চোলাই রুখে বলছেন মঙ্গলারা

মাস পাঁচেকের লড়াইটা জিতে গেলেন জয়ন্তী, মঙ্গলা, রিঙ্কুরা। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে মরদের মার খেতে খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তাঁদের। নিত্যদিনের ঝগড়া-অশান্তির মূলে যে চোলাই, বিলক্ষণ বুঝেছিলেন।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৩৯
Share:

এই ক্লাব থেকে শুরু হয়েছিল চোলাই বিরোধী অভিযান। —দীপঙ্কর দে

মাস পাঁচেকের লড়াইটা জিতে গেলেন জয়ন্তী, মঙ্গলা, রিঙ্কুরা।

Advertisement

সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে মরদের মার খেতে খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তাঁদের। নিত্যদিনের ঝগড়া-অশান্তির মূলে যে চোলাই, বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। তারকেশ্বরের শ্যামপুর গ্রামের এই মহিলারাই মাস পাঁচেক আগে পণ করেন চোলাইয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। পাশে পেয়ে যান স্থানীয় ক্লাবের ছেলেদের। সকলে মিলে নেমে পড়েন লাগাতার অভিযা‌নে। প্রথমে পুরুষদের বোঝানো। তার পরে চোলাই নষ্ট করা। ফলও মিলেছে হাতেনাতে।

মাস তিনেক ধরে এই গ্রামে চোলাই বিক্রি বন্ধ। যাঁরা এক সময়ে চোলাইয়ে আসক্ত ছিলেন, নেশার জন্য ঘরের ঘটিবাটি বেচে দিতেন, এখন তাঁরাই নিয়মিত কাজে যাচ্ছেন। ঘরের পুরুষদের পাল্টে দিতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন রাধা সরেন, রেবা বাগ, রিঙ্কু মাঝিরা। ঘরে দু’পয়সা আসছে। অশান্তি উধাও হয়েছে। মহিলারা এককাট্টা, গ্রামে চোলাইয়ের রমরমা আর নয়। তাঁদেরই এক জন বলছেন, ‘‘বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে এগিয়ে এসে যে কাজ করতে হয়েছে, এখানে আমরা শুধু বুঝিয়েই সেই কাজ করেছি।’’ আর গ্রামের পুরুষেরা বলছেন, চোলাইয়ের নেশা অতীত। এখন তাঁরা কাজে ব্যস্ত।

Advertisement

শ্যামপুর গ্রামটি তফসিলি জাতি, উপজাতি অধ্যুষিত। সেখানে মহিলাদের এই লড়াইকে সাধুবাদ জানিয়েছেন পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা। পুলিশ ও আবগারি দফতর জানিয়েছে, ওই এলাকায় মাঝেমধ্যেই অভিযান চলে। ওই গ্রামে আগে অভিযানের পরে লুকিয়ে-চুরিয়ে ফের চোলাই ব্যবসা শুরু হতো। এখন সে সব বন্ধ। গ্রামের মহিলা এবং ক্লাব সদস্যদের উদ্যোগ প্রশংসা করার মতো।

গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই খেতমজুর। বছরের পর বছর ধরে চোলাইয়ের রমরমায় গ্রামের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বাড়ির পুরুষেরা চোলাই খাবে, রাস্তাঘাটে পড়ে থাকবে, বাড়ি ফিরে বউ-মেয়েকে পেটাবে— এমনটাই যেন রোজনামচা হয়ে গিয়েছি‌ল! চোলাই খেয়ে কয়েক বছর আগে গ্রামের তিন যুবক মারাও গিয়েছেন। তবু ছবিটা বদলায়নি।

কয়েক মাস আগে হঠাৎই গ্রামের জনা কুড়ি মহিলা এলাকার সিধু-সুভাষ সঙ্ঘে যান। ক্লাবের ছেলেদের কাছে আর্জি জানান, চোলাই বন্ধ করতে কিছু করা যায় কি না! ক্লাবের কিছু সদস্য যেন এটাই চাইছিলেন। মহিলাদের নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা। গ্রামের গোটা ছয়েক বাড়িতে চোলাই বিক্রি হতো। সেখানে গিয়ে সকলে চোলাই বিক্রি বন্ধ করার আবেদন জানান। প্রথমেই অবশ্য বন্ধ হয়নি। দু’-তিন দিন পর পর অভিযান চলতে থাকে। প্রথম দিকে চাপ আসত। চোলাইয়ের ক্রেতা-বিক্রেতারা এই ‘বাড়াবাড়ি’ সহ্য করা হবে না বলে হুমকিও দিতেন বলে অভিযোগ। ক্লাবের ছেলেরা বা প্রমীলা বাহিনী দমে যাননি। চোলাইয়ে আসক্ত পুরুষদের বোঝাতে থাকেন তাঁরা। তাঁদের চেষ্টায় কিছু দিনের মধ্যেই গ্রামে চোলাই বিক্রি কার্যত বন্ধ হয়। তবে অনেকে বাইরে থেকে চোলাই কিনে ফিরতেন। তাঁদের ব্যাগপত্র তল্লাশি শুরু হয়। চোলাই পেলেই তা নষ্ট করে দেওয়া হতো। এ ভাবেই পাল্টাতে থাকল গ্রামের ছবিটা।

চোলাই বন্ধের অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন জয়ন্তী হেমব্রম। তিনি জানান, স্বামী আগে নিত্যদিন মদ্যপ অবস্থায় অশান্তি করতেন। কাজে যেতেন না। ঘটিবাটি বেচেও চোলাই খেয়েছেন। তবে এখন জয়ন্তীদেবী খুশি। স্বামী মনো হেমব্রম ট্রাক থেকে মাল খালাসের পুরনো কাজটাই মন দিয়ে করছেন। মনো বলেন, ‘‘সবাই খুব বুঝিয়েছে। আর মদ খাব না। মন দিয়ে কাজ করব। সংসার করব।’’ বছর তেতাল্লিশের দেবু দাস প্রায় ২০ বছর ধরে মদ খাচ্ছিলেন। অসুখেও ভুগেছেন। সামনে মেয়ের বিয়ে। সেই মানুষটাই বিলকুল বদলে গিয়েছেন। দেবুর কথায়, ‘‘কয়েক মাস ধরে মদ ছুঁই না। আগে মদ খেয়ে মজা পেতাম। এখন মদ না খাওয়ার মজা পাচ্ছি। এই আনন্দ অনেক বেশি। নিজেও লোকজনকে মদ খেতে বারণ করছি।’’

ক্লাব সদস্যেরা জানান, এখন হয়তো হাতেগোনা দু’-এক জন বাইরে থেকে চোলাই খেয়ে আসছেন। তাঁদের বোঝানো হচ্ছে। স্কুলশিক্ষক শ্যামলকুমার দাস ওই ক্লাবের সদস্য। তিনি বলেন, ‘‘চোলাই খাওয়ার জেরে অকালে তারতাজা তিনটি প্রাণ ঝরে গিয়েছে। তাঁদের ঘরের মেয়ে-বউরাও অভিযানে সামিল হচ্ছেন। নিজেদের দুর্দশার কাহিনি শুনিয়ে অন্যদের সচেতন করছেন।’’ ক্লাবের সম্পাদক মুকুল মুর্মু বা গৃহবধূ চম্পা মাণ্ডি, দেবী সরেন— সকলেই চোলাই রুখতে বদ্ধপরিকর।

গ্রামে সুস্থ পরিবেশ ফিরে এসেছে। সকালে পুরুষেরা কাজে বেরোচ্ছেন। রাতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। বধূরা বলছেন, ‘‘এত দিনে মরদ মানুষ হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন