শরৎচন্দ্রের বাড়ি।
বইয়ের পাতা থেকেই যেন উঠে এসেছে চরিত্রগুলি। গোটা মেলা জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে তারা।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে ৪৩ বছর ধরে বাগনানের পানিত্রাস হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত হচ্ছে শরৎ মেলা। এ বার ৪৪ বছরে পা দিয়েছে মেলা। সেরা আকর্ষণ কথাশিল্পীর বিভিন্ন উপন্যাস এবং ছোট গল্পের চরিত্রগুলির আদলে তৈরি মাটির মডেল নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী। ছাপার অক্ষরে শরৎকাহিনীর সঙ্গে পরিচিত নন এমন বাঙালি বিরল। তাঁর লেখা উপন্যাস এবং ছোট গল্প নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রের সংখ্যাও কম নয়। সে সবের সঙ্গেও পরিচিত বহু মানুষ। মেলাতেও ‘অরক্ষণীয়া’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘রামের সুমতি’-র মতো উপন্যাস এবং ছোট গল্পের নায়কদের অবাধ বিচরণ।
পানিত্রাসের গা ঘেঁষেই সামতা ও গোবিন্দপুর। শরৎচন্দ্রের দিদি অনিলাদেবীর বিয়ে হয়েছিল গোবিন্দপুরে। সেই সূত্রে এলাকায় যাতায়াত ছিল তাঁর। পরে সামতায় জমি কিনে শরৎচন্দ্র বাড়ি তৈরি করেন। গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে বাড়ি হওয়ায় তিনি গ্রামের নাম দিয়েছিলেন সামতাবেড়। মাটির দোতলা বাড়িতে মৃত্যুর আগে শেষ ১২টা বছর তিনি কাটিয়েছিলেন। পথের দাবি, বিপ্রদাস, শ্রীকান্তর তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব লিখেছিলেন এই বাড়িতে বসেই।
জীবদ্দশায় তো বটেই, কথাশিল্পীর মৃত্যুর পরেও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে এই বাড়ি তীর্থক্ষেত্র হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। এখনও প্রচুর মানুষ কথাশিল্পীর স্পর্শ পেতে আসেন। কথাশিল্পীর এমন জনপ্রিয়তাকে সামনে রেখে উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে এলাকাও। দেউলটি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটি ঝাঁ চকচকে। কথাশিল্পীর নামে রয়েছে আস্ত একটি গ্রাম পঞ্চায়েত। রূপনারায়ণ নদের ভাঙন যাতে এই স্মৃতিচিহ্নকে গ্রাস করতে না পারে সে জন্য ভাঙন রুখতে সাড়ে চার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রশাসন। ইতিমধ্যে বাড়িটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করে তার সংস্কার করেছে হেরিটেজ কমিশন।
কথাশিল্পীর লেখায় বারে বারেই উঠে এসেছে সমাজের শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কথা। তাকে সম্মান জানিয়ে পাশেই গোবিন্দপুর গ্রামে ৬২টি ধীবর পরিবারের জন্য সরকারি তরফে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে পাকা বাড়ি। কথাশিল্পীর বাড়ির অদূরে ‘শরৎবন’ নামে পর্যটনকেন্দ্র গড়তে উদ্যোগী হয়েছে জেলা পরিষদ। রয়েছে শরৎস্মৃতি গ্রন্থাগার যা টাউন লাইব্রেরি হিসাবে স্বীকৃত।
উন্নয়নের এই কর্মযজ্ঞে রঙিন পালকটি হল শরৎমেলা। শুরুর বছরে মেলা ছিল একদিনের। পরে তার মেয়াদ বেড়েছে। এখন মেলা সাতদিনের। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে মেলা। চলবে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। মেলায় লোকজনদের আসার জন্য ১১টি সিটিসি বাস নিয়মিত চলাচলের ব্যবস্থা হয়েছে। মেলায় প্রদর্শনী ছাড়াও থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা, আলোচনাসভা প্রভৃতি। মেলা পরিচালন সমিতির তরফে শ্রীকান্ত সরকার, প্রণব ঘোষাল, দেবনারায়ণ মাইতি, অসিতরঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘‘শরৎচন্দ্র মানুষের মধ্যে থাকতে ভালবাসতেন। মেলার কয়েকটা দিন হাজার হাজার মানুষ শুধু তাঁর কথাই স্মরণ করেন। তাঁকে নিয়ে চলে নানা আলোচনা। সেই পরিবেশ যাতে বজায় থাকে ও সর্বাঙ্গসুন্দর হয় আমাদের চেষ্টা থাকবে সেটাই।’’
ছবি: সুব্রত জানা।