রাস্তায় সাধারণ পটকা ফাটলেও এখন অনেকে কাঁপছেন।
ঘুম উবেছে অনেক নেতার।
খুনখারাপি বন্ধে কেউ আবার সরাসরি নবান্নের হস্তক্ষেপ চাইছেন।
রাস্তার মধ্যে ভদ্রেশ্বরের পুরপ্রধান মনোজ উপাধ্যায় গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার পরে হুগলি জেলা জুড়েই আতঙ্ক পৌঁছেছে চরমে। নিরাপত্তা কী ভাবে ফিরবে, এই প্রশ্নেই তোলপাড় হচ্ছে চায়ের দোকান, পাড়ার ক্লাব, গঙ্গার ঘাট। একই সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধেও চলছে বিষোদ্গার।
ভদ্রেশ্বরেরই এক স্কুলশিক্ষকের প্রশ্ন, ‘‘চেয়ারম্যান এ ভাবে খুন হলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?’’ এ শহরেরই সাহিত্যকর্মী মধুময় পাল বলেন, ‘‘হুগলির বিরাট অঞ্চল যেন দুষ্কৃতী-অধ্যুষিত। কিছু দিন আগে ভদ্রেশ্বরে অস্ত্র কারখানার হদিস মিলেছিল। জেলা জুড়ে অস্ত্রের রমরমা। সাধারণ মানুষ বিপন্ন বোধ করছেন। পুলিশের উপরে অনাস্থা বাড়ছে।’’ চন্দননগর সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শুভেন্দু মজুমদার বলেন, ‘‘প্রশাসনের কঠোর হওয়া দরকার। রাজনৈতিক স্তরে সদর্থক ভূমিকা পালন করা তার থেকেও জরুরি। সাধারণ মানুষকেও সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।’’ শ্রীরামপুরের এক ব্যবসায়ীর প্রশ্ন,, ‘‘চম্বল হয়ে ওঠা এই শহরে আবার কবে স্বাভিবক ছন্দে ফিরবে?’’
হুগলিতে দুষ্কৃতীদের কার্যকলাপ নতুন নয়। কিন্তু বছর খানেক ধরে তা যে মাত্রায় পৌঁছেছে এবং সাধারণ মানুষ তার শিকার হচ্ছেন, তেমনটা আগে কখনও হয়নি বলে দাবি করেছেন শিল্পাঞ্চলের বহু মানুষ। তাঁদের মতে, শিল্পাঞ্চল এখন ‘সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চল’। বহু ক্ষেত্রেই শাসকদলের নেতাদের দুষ্কৃতী-যোগ পরিস্থিতি জটিল করছে।
শিল্পাঞ্চলে পুলিশ কমিশনারেট তৈরির পরেও দুষ্কর্ম বেড়েই চলেছে বলে অভিযোগ। গত দেড় মাসে শ্রীরামপুর, শেওড়াফুলি, নবগ্রাম, কোন্নগর, রিষড়ার মতো জায়গায় জনবহুল এলাকায় প্রকাশ্যে হামলা চালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। কোথাও খুন হয়েছেন ইমারতি ব্যবসায়ী। কোথাও বোমার আঘাতে জখম হন সাধারণ মানুষ। কোথাও আবার বন্দুকের মুখে পড়েছেন সাধারণ ব্যবসায়ী। আর মঙ্গলবার খুন হলেন ভদ্রেশ্বরের পুরপ্রধান। প্রকাশ্যে হামলা চালানোর মতো সাহস দুষ্কৃতীরা কোথা থেকে পাচ্ছে, উঠছে সেই প্রশ্ন।
দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্যের প্রশ্নে শাসকদলকেই কাঠগড়ায় তুলছেন বিরোধীরা। জেলা বিজেপি সভাপতি ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পুলিশকে দলদাস করে রাখা হয়েছে। কমিশনারেট গঠন লোকদেখানো।’’ জেলা সিপিএম সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘হুগলি সন্ত্রাসের জেলা হয়ে উছেছে। বিভিন্ন ঘটনায় শাসকদলের নেতা বা তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের নাম উঠে আসছে।’’ কংগ্রেস নেতা দিলীপ নাথের প্রশ্ন, ‘‘এত অস্ত্র আসছে কোথা থেকে? পুলিশ কেন তা বাজেয়াপ্ত করছে না?’’
চন্দননগর কমিশনারেট বা গ্রামীণ পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকদের দাবি, জেলা জুড়ে দুষ্কৃতীদের ধড়পাকড় চলছেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। জেলা তৃণমূল সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে পুলিশ-প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গেই কাজ করছে। কোনও ঘটনায় দলের রং না দেখেই পুলিশ ব্যবস্থা নেয়।’’
সাধারণ মানুষ অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, বারবার পুলিশ এবং শাসকদলের আশ্বাস সত্ত্বেও পরিস্থিতি কেন ক্রমেই খারাপ হচ্ছে?
তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে শাসকদলের নেতাদের উপর দুষ্কৃতী হামলা এই জেলায় নতুন নয়। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চণ্ডীতলার ভগবতীপুরে দলীয় কার্যালয়ে আক্রান্ত হন জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ আসফার হোসেন। দুষ্কৃতীরা তাঁর মাথায় চপারের কোপ মারে। বুকে গুলি করে। দু’বছর আগে শ্রীরামপুরের মল্লিকপাড়ায় সাতসকালে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমায় জখম হন তৃণমূলের যুবনেতা, পুর-পারিষদ উত্তম রায়। বছর আড়াই আগে রিষড়া স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হন তৎকালীন রিষড়ার চেয়ারম্যান ইন-কাউন্সিল বিজয়সাগর মিশ্র। চলতি বছরেই ১৫ অগস্ট ভোরে আরামবাগের তৃণমূল নেতা দীপক সরকারের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ মেলে বাড়ির কাছেই।
সেই তালিকায় এ বার যুক্ত হল মনোজ উপাধ্যায়ের নামও।