ভোলানাথ হত্যা

পোশাক বদলেও রক্ষা হয়নি

গঙ্গার পশ্চিমপারের জেলা হুগলিতে নব্বই দশকের মাঝামাঝি গুলি করে খুন করা হয়েছিল একটি থানার দাপুটে বড়বাবুকে। দুষ্কৃতী দমনে যাঁর দাওয়াই ছিল আর পাঁচজন ওসির তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। সেই সময় পুলিশ ও রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন ফেলেছিল এই খুনের ঘটনা। কিন্তু কেন? নব্বই দশকে পুলিশ, রাজনীতি, দুষ্কৃতী—সমান্তরাল ছবির সেই পটভূমিকায় আনন্দবাজারের অনুসন্ধান। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ডানকুনি এলাকায় একটি খুনে হুগলি জেলার বাঘা বাঘা পুলিশ-কর্তাদের ঘুম চলে গিয়েছিল। কিছুতেই খুনের কিনারা হয় না! অথচ, দু্ষ্কৃতী ধরার জন্য উপর মহলের লাগাতার চাপ। শেষে ডাক পড়ল ভদ্রেশ্বর থানার ওসি ভোলানাথ ভাদুড়ির। কেননা, জেলা পুলিশের বড় কর্তাদের ভরসা ছিল, পারলে তিনিই পারবেন।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

ভদ্রেশ্বর শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০১:২৩
Share:

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ডানকুনি এলাকায় একটি খুনে হুগলি জেলার বাঘা বাঘা পুলিশ-কর্তাদের ঘুম চলে গিয়েছিল। কিছুতেই খুনের কিনারা হয় না! অথচ, দু্ষ্কৃতী ধরার জন্য উপর মহলের লাগাতার চাপ। শেষে ডাক পড়ল ভদ্রেশ্বর থানার ওসি ভোলানাথ ভাদুড়ির। কেননা, জেলা পুলিশের বড় কর্তাদের ভরসা ছিল, পারলে তিনিই পারবেন।

Advertisement

জেলার এক প্রবীণ পুলিশ অফিসার তাঁর স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন সেই খুনের কাহিনি। বিমা সংস্থার এক এজেন্টের সঙ্গে এলাকার এক সোনার দোকানের মালিকের বিবাদ। পরিণতিতে খুন হন বিমা সংস্থার এজেন্ট। দেহ উদ্ধারের পরে পুলিশ পড়ে ধন্দে। এজেন্টের গায়ে যে সোনা ব্যবসায়ীর পোশাক! ওই সোনা ব্যবসায়ীর স্ত্রী সেগুলি শনাক্ত করেন। তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগেও জানান, বিমা সংস্থার এজেন্ট নন, আসলে খুন হয়েছেন তাঁর স্বামী।

তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন ওঠে, সোনা ব্যবসায়ীকে খুন করা হলে ওই এজেন্টকে তা হলে কে মারল? আর সোনা ব্যবসায়ী খুন হয়ে থাকলে তাঁর দেহ গেল কোথায়? এই রহস্যের গিঁট খুলতে গিয়েই পুলিশ পড়ে ফাঁপরে। পুলিশ-কর্তারা জানাচ্ছেন, ভোলানাথবাবুর ছিল ঘটনার পিছনে লেগে থাকার মানসিকতা এবং বিশ্লেষণ করার দক্ষতা। তাকে সম্বল করেই তিনি রহস্যের কিনারা করেন। ভোলানাথবাবুর তদন্তে উঠে আসে ওই সোনা ব্যবসায়ী আদৌ খুন হননি। তিনি পুলিশকে স্রেফ বিভ্রান্ত করতেই ঠান্ডা মাথায় বিমা সংস্থার এজেন্টকে খুন করে নিজের পোশাক পরিয়ে গা-ঢাকা দেন।

Advertisement

ভোলানাথবাবুর এই তদন্তের কথা জেলার পুরনো পুলিশ অফিসারদের মুখে মুখে ফেরে এখনও। কিন্তু কী করে তিনি তদন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন? পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কেউ আক্রান্ত হলে তিনি প্রাণে বাঁচতে নানা পন্থা নিতে পারেন। ধস্তাধস্তি- মারপিট পর্যন্ত হতে পারে। তার জেরে পোশাকে বা ঘটনাস্থলে তার ছাপ পড়তে বাধ্য। ঘটনাস্থলে অপরাধীর নানা চিহ্ন (ক্লু) থাকে। কিন্তু ডানকুনির ওই ঘটনার ক্ষেত্রে তা ছিল না। একেবারে প্রতিরোধহীন অবস্থায় পরিপাটি করে তার পোশাক পাল্টানো হয়েছিল। সেই থেকেই ভোলাবাবুর সন্দেহের সূত্রপাত। সেই পথে এগিয়েই তিনি সাফল্য পান।

কোনও এলাকায় নতুন ওসি কাজে যোগ দিলে দুষ্কৃতীরা নিজস্ব ওজনদারিতে তাঁকে মাপে। উল্টোটাও হয়। ওসি-র দায়িত্ব বুঝে নিয়ে প্রথম দিন থেকেই বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসারেরা ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করেন। এলাকার দুষ্কৃতীদের তালিকা করেন। আগের ওসির করা তালিকার সঙ্গে তাঁরা মিলিয়ে দেখেন, কারা বাইরে এবং কারা জেলে। অনেক পুলিশ অফিসারের মারধর, হাঁক-ডাকের অভ্যাস থাকলেও ভোলানাথবাবুর ছিলেন এর বিপরীত মেরুর। তিনি এলাকার দুষ্কৃতীদের তালিকা তৈরি করে তথ্য সংগ্রহ করতেন। তাদের থানায় ডাকতেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে জানাতেন। প্রথমে চাপ সৃষ্টি করতেন। কাজ না হলে গ্রেফতারের হুমকি। ক্রমাগত পুলিশের তাড়া খেয়ে এক সময় দুষ্কৃতীরা মাথা নিচু করত পুলিশের কাছে। জেলা পুলিশের পুরনো ফাইল থেকে জানা যাচ্ছে, ভদ্রেশ্বর এলাকায় সেই সময় দীপুয়া, ভাকালুয়া, সুভাষ সাহানির মতো দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াত। দুষ্কর্ম করে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিত।

ভোলানাথবাবু দুষ্কৃতীদের অতীত ঘেঁটে তাদের অপরাধের পরিসংখ্যান (ক্রাইম রেকর্ড) জোগাড় করে তাদের সামনে ফেলে দিতেন। তার পর ট্যাঁ-ফোঁ করলেই গ্রেফতার। দুষ্কৃতীদের সঙ্গে মেলামেশা করে নিজস্ব ‘সোর্স’ও তৈরি করতেন ভোলানাথবাবু। জেলা পুলিশে ভোলাবাবুর এক সহকর্মীর কথায়, ‘‘দুষ্কৃতীদের থেকে যেমন তিনি খবর নিতেন, তাদের পরিবারকেও দেখতেন। টাকা দিতেন, কাজের সুযোগ করে দিতেন। তাতে দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তাঁর তালমিল ভাল হয়েছিল। কিন্তু কোনও কোনও সময় তিনি দুষ্কৃতীদের আগুপিছু বিবেচনা না করেই বিশ্বাস করতেন।’’ সেই বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত তাঁর কাল হয়ে উঠেছিল। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন