বয়সের ভারে বেহাল। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
বয়স ৮৫ বছর। শরীর জুড়ে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। চিকিৎসকেরাও পরীক্ষা করে জরুরি ভিত্তিতে ‘অস্ত্রোপচার’-এর নিদান দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অস্ত্রোপচার হয়নি এখনও। ফলে রোজই শরীরে ক্ষত বাড়ছে। আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত বিপজ্জনক ভাবে যানবাহনের ভার বয়ে চলেছে ওই বৃদ্ধ।
রোগ-জর্জরিত এই বৃদ্ধ বালি ব্রিজের জন্ম ১৯৩১ সালে। বালি ও দক্ষিণেশ্বরের মধ্যে গঙ্গার উপর দিয়ে সংযোগকারী এই গুরুত্বপূর্ণ রেল ও সড়ক সেতুর অবস্থা এতটাই বিপজ্জনক যে, বহুদিন আগেই তাতে ভারী মালবাহী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই ওই ব্রিজের দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তায় দেখা দিয়েছে ফাটল। আর প্রশাসনের তরফেও সেই ফাটল জোড়াতাপ্পি দিয়ে দায় সারা হচ্ছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
বারবার এই ফাটল কেন হচ্ছে, সেই রোগও শনাক্ত করে ফেলেছিলেন পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা। রাস্তার কংক্রিটের নীচে রয়েছে ‘এক্সপ্যানশন জয়েন্ট’। বিস্তর সমস্যা সেখানেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব বহু পুরনো এক্সপ্যানশন জয়েন্ট পাল্টানো উচিত বলে নিদান দেন ইঞ্জিনিয়ারেরা। রোগ ধরা পড়লেও তা সারানোর কোনও ব্যবস্থা কেন হচ্ছে না?
পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, কয়েক মাস আগে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরুর জন্য রেলের সঙ্গে বৈঠক করেন পূর্ত-কর্তারা। সিদ্ধান্ত হয় মেরামতির কাজে সাহায্য করবে রেল। গত ফেব্রুয়ারির গোড়ায় রেল, রাজ্য পুলিশের কর্তাদের নিয়ে সেতু পরিদর্শন করেন পূর্ত-কর্তারা। সেতুর দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তা বন্ধ রাখার সময়ে নিবেদিতা সেতু ব্যবহার করার জন্য জাতীয় সড়কের কর্তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেন পুলিশকর্তারা। কিন্তু তিন মাস কেটে গেলেও সব কিছু থেকে গিয়েছে শুধুই পরিকল্পনার স্তরেই।
বালি ব্রিজের দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তাটি লম্বায় ৮৮০ মিটার, চওড়ায় সাড়ে ৭ মিটার (এর মধ্যে ফুটপাথ দু’মিটার)। পুরো অংশটাই কংক্রিটের আস্তরণে ঢাকা। এর নীচেই রয়েছে ১১টি এক্সপ্যানশন জয়েন্ট। পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘বালি ব্রিজের এক্সপ্যানশন জয়েন্টের অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে চারটির অবস্থা বিপজ্জনক। বাকিগুলির অবস্থাও ক্রমশ বিপজ্জনক হচ্ছে।’’ এই এক্সপ্যানশন জয়েন্টের অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্যই কংক্রিটের আস্তরণে ফাটল ধরছে বলে মনে করছেন পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা। প্রতিনিয়ত গাড়ির চাপে সেই ফাটল বড় হয়ে তৈরি হচ্ছে গর্ত। কোনও সময়ে তা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীচের গঙ্গা। গর্ত বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যানজট ঘটছে ব্রিজের ওই রাস্তায়। ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনাও।
এই এক্সপ্যানশন জয়েন্টের গুরুত্ব কী? ‘‘এই জয়েন্টই সেতুর কাঠামোর মূল অংশের একটি,’’ জানাচ্ছেন সেতু বিশেষজ্ঞ অলোক সরকার। অলোকবাবুর কথায়, ‘‘গরম ও শীতকালে তাপমাত্রা অনেক পরিবর্তন হওয়ার ফলে দু’টি জয়েন্টের মধ্যে দূরত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন সামলানোর জন্যই সেতুতে এক্সপ্যানশন জয়েন্ট দিতে হয়। তাতে সেতু গাড়ির চাপ সহ্য করতে পারবে, কংক্রিটেও কোনও সমস্যা দেখা দেবে না।’’ তবে যে কোনও সেতুর ক্ষেত্রেই এক্সপ্যানশন জয়েন্টের আয়ু ২৫-৩০ বছরের বেশি হয় না বলেই মনে করেন অলোকবাবু। কিন্তু পূর্ত দফতরের রেকর্ড বলছে, শেষ ৫০ বছরে বালি ব্রিজের ওই রাস্তায় জয়েন্ট পরিবর্তন হয়নি। এখানেই বিপদ দেখতে পাচ্ছেন সেতু বিশেষজ্ঞেরা।
কিন্তু কবে থেকে শুরু হবে ওই এক্সপ্যানশন জয়েন্টের মেরামতি?
নবান্ন সূত্রে বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারিতে মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং সাঁতরাগাছি সেতু সংস্কারের জন্য সেই মুহূর্তে বালি ব্রিজের কাজ চালু করতে পারেনি রাজ্য সরকার। তবে এখন এই এক্সপ্যানশন জয়েন্ট পরিবর্তনের জন্য পূর্ত দফতর তৈরি বলেই দাবি এক শীর্ষ কর্তার। তাঁর কথায়, ‘‘রেল এবং আমরা তৈরি হয়ে বসে রয়েছি। পুলিশের তরফে সবুজ সঙ্কেত মিললেই কাজ শুরু করা হবে।’’ যদিও রাজ্য পুলিশের এডিজি (ট্রাফিক) কুন্দনলাল টামটা বলেন, ‘‘ব্যারাকপুর ও হাওড়ার পুলিশ কমিশনারদের বলা রয়েছে। পূর্ত দফতর তার সময় মতো কাজ শুরু করতেই পারে।’’
রাজ্য পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘‘সমস্যাটি খুবই গুরুতর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শুরু করতে না পারলে বিপদ বাড়বে। সেটা আমরা উপরতলায় জানিয়েছিলাম। সেই ফাইল নড়েছে কি না, জানি না।’’ পূর্ত দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘বালি ব্রিজের সমস্যা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এখনও কেন যে মেরামতি হয়নি, তা বুঝতে পারছি না।’’