বিশ্রাম: কাজ নেই। তাই গরমের দুপুরে চুঁচুড়া আদালত চত্বরে ঘুম। শুক্রবার দুপুরে। নিজস্ব চিত্র
এমনিতেই বাড়তি বন্দি থাকে বছরভর। আদালতে কর্মবিরতির জেরে সেই সংখ্যা বেড়েই চলেছে হুগলির বিভিন্ন জেলে।
কারা দফতর সূত্রের খবর, হুগলি জেলে শ’চারেক বন্দি থাকার কথা। গত ২৪ এপ্রিল এখানে ৫৫০ জন বন্দি ছিলেন। শুক্রবার সেই সংখ্যা ৬০০ ছুঁয়েছে। এক কারাকর্তার কথায়, ‘‘আইনজীবীরা সওয়াল না-করায় অনেকেই জামিন পাচ্ছেন না। তাতেই এই পরিস্থিতি। এর থেকে বেশি বন্দি হলে স্থান সঙ্কুলান করা মুশকিল হবে।’’
শ্রীরামপুর জেলেও ঠাঁই নাই দশা। এখানে একশোর কিছু বেশি বন্দি থাকার কথা। থাকে কার্যত দ্বিগুণ। গত ২৪ এপ্রিল এখানে বন্দির সংখ্যা ছিল ২০৭ জন। গত তিন সপ্তাহে বন্দির সংখ্যা বেড়েছে। শুক্রবার এখানে ২৪১ জন বন্দি ছিল। চন্দননগর জেলে ১০০ জন থাকার কথা। শুক্রবার এখানে ১২২ জন বন্দি ছিল।
শ্রীরামপুর আদালতের এক আইনজীবী বলেন, ‘‘এটা বলাই যায় যে, আইনজীবীরা সওয়াল করলে অনেকেরই জামিন পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।’’ এক মুহুরি বলেন, ‘‘আইনজীবীরা সওয়াল না করায় অপেক্ষাকৃত লঘু মামলার ক্ষেত্রেও জামিন পাওয়া মুশকিল হচ্ছে।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবীর কথায়, ‘‘পরিস্থিতির জন্য অনেকেই জামিন পাচ্ছেন না। জেল
উপচে পড়ছে।’’
গত ২৪ এপ্রিল হাওড়া আদালতের আইনজীবীদের উপরে পুলিশি নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। তার পরের দিন থেকে রাজ্যের সব আদালতে আইনজীবীদের কর্মবিরতি শুরু হয়। ফলে, নানা কাজে আদালতে এসে হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আইনজীবীরা না-দাঁড়ানোয় লঘু অপরাধের ক্ষেত্রেও জামিন মিলছে না। একই ছবি হুগলিতেও।
শুক্রবার বেলা দেড়টা। কার্যত ফাঁকা হুগলি জেলা আদালত চত্বর। চেনা ভিড়টা উধাও। শুকনো মুখে আদালতের অদূরে দাঁড়িয়েছিলেন চুঁচুড়ার খাদিনা মোড়ের বাসিন্দা শেখ লিয়াকত আলি। জানালেন, জরুরি ভিত্তিতে একটি জমি রেজিস্ট্রি করানো দরকার। কিন্তু দিন কুড়ি ধরে ঘুরেও সেই কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘‘আট-ন’বার আদালতে এসেছি। শুনছি কর্মবিরতি না উঠলে কিছু করার নেই।’’ লিয়াকতের প্রশ্ন, ‘‘ওঁদের সমস্যার জন্য সাধারণ মানুষকে ভুগতে হবে কেন?’’ মামলা সংক্রান্ত কাজে আদালতে এসেছিলেন গুড়াপের বাসিন্দা সঞ্জয় ও লক্ষ্মী মাহাতোও। বৃদ্ধ এই দম্পতিকেও হয়রান হয়ে ফিরতে হল। লক্ষ্মীর ক্ষোভ, ‘‘উকিল বলেছেন, মামলার নিষ্পত্তি হয়ে এসেছে। কিন্তু ফের তো পিছিয়ে গেল।’’
বিচারপ্রার্থীদের অসুবিধার কথা অস্বীকার করছেন না আন্দোলনকারী আইনজীবীরাও। তবে তাঁদের যুক্তি, ‘সামগ্রিক ভাবে বিচার ব্যবস্থার স্বার্থে’ই হাওড়ার ঘটনার বিহিত হওয়া জরুরি। সেই কারণেই কর্মবিরতি চলছে। হুগলি জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শুভাশিস চন্দ বলেন, ‘‘কর্মবিরতি নিয়ে একটা ভুল বার্তা যচ্ছে। আমরা চাই সঠিক বার্তা পৌঁছক। হাওড়া কোর্টে পুলিশ জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো বর্বরোচিত আক্রমণ করেছে। আদালতে ঢুকতে বিচারকের অনুমতি পর্যন্ত নেয়নি। পুলিশ এ ভাবে বিচার ব্যবস্থাকে থমকে দিলে মানুষ কার কাছে যাবে? পুলিশের এই অনৈতিক আগ্রাসনের বিহিত হওয়াটা বিচারপ্রার্থীদের জন্যেও জরুরি।’’
আইনজীবী গোপাল চট্টোপাধ্যায়, দীপান্বিতা সিংহদের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে বা তাদের কাছে বিচার না-পেয়ে সাধারণ মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হন। আইনজীবীরা পুলিশের বিরুদ্ধে সওয়াল করেন। কিন্তু হাওড়ার ঘটনায় পুলিশ বিচার ব্যবস্থার উপরেই আঘাত হেনেছে। তবে, আইনজীবীদেরই একাংশের মতে, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি এড়াতে প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হোক। দীপাণ্বিতা বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি নিরপেক্ষ ভাবে বিষয়টি দেখছেন। আশা করছি, দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। বিচারপ্রার্থীদেরও জয় হবে।’’ এ দিন বিষয়টি নিয়ে জেলা বিচারকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয় আইনজীবীদের সংগঠনের তরফে। আইনজীবীরা মিছিলও করেন।
তবে, আরামবাগ জেলে বন্দির সংখ্যা কমেছে। গত ২৪ এপ্রিল এখানে ৮০-৮৫ জন বন্দি ছিল। শুক্রবার সেই সংখ্যাটা ছিল প্রায় ২০ জন। আরামবাগ আদালতের আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, আইনজীবীরা সওয়াল না করলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক গোলমালের ঘটনায় ধৃতদের বিচারক ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দিয়েছেন। চন্দননগর আদালতও কয়েকজনকে একই ভাবে জামিন দিয়েছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
তথ্য সহায়তা: পীযূষ নন্দী।