বিয়ের ভোজে মাংস, খাসির ডাক শুনতে চান বরকর্তা

কলকাতার নামজাদা রেস্তরাঁয় মৃত পশুর মাংস ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে তদন্তে। আর তারপরই লাটে উঠেছে মফস্সলের খাবার দোকানগুলির ব্যবসাও।

Advertisement

তাপস ঘোষ

চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫৮
Share:

অবসর: ফাঁকা দোকানে গান শুনছেন এক কর্মী। চুঁচুড়ায়।

ছেলের বিয়ের মেনুতে মটন রেজালা করতে চেয়েছিলেন ব্যান্ডেলের দাশরথী হালদার। কেটারারকে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘‘খাসি কাটা হবে আমার চোখের সামনে।’’ রাশভারী দাশরথীবাবু বলছেন, ‘‘খাসির ডাক শুনে তবে রান্নার অনুমতি দেব। কোনও রকম ফাঁকিবাজি চলবে না।’’ রোল, কাটলেট কি পকোড়া, চাঁপ, দোপিঁয়াজ়া থেকে ঝোল-ঝাল, বিরিয়ানি— বাঙালির দুপুর, বিকেল, সন্ধেগুলো ভরিয়ে রাখা পদ হঠাৎ হয়েছে বিস্বাদ। মুরগি হোক বা খাসি— বাঙালির যেন মন নেই।

Advertisement

কলকাতার নামজাদা রেস্তরাঁয় মৃত পশুর মাংস ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে তদন্তে। আর তারপরই লাটে উঠেছে মফস্সলের খাবার দোকানগুলির ব্যবসাও। উত্তরপাড়া থেকে শ্রীরামপুর, ভদ্রেশ্বর, চাঁপদানি, চন্দননগর, চুঁচুড়া বা ব্যান্ডেল শহুরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে গজিয়ে ওঠা বিরিয়ানির দোকানগুলো গত কয়েকদিন ধরেই মাছি তাড়াচ্ছে। প্রথম দিকে তৈরি হচ্ছিল হাঁড়ি হাঁড়ি বিরিয়ানি। কিন্তু এক হাঁড়ি বিক্রি করতেই নাকানি-চোবানি খেতে হচ্ছে মালিককে। তাই গত দু’দিনে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে রান্না। একই অবস্থা রোল, কাটলেটেরও। চিকেন বা মটন রোলের চাহিদা নেমে গিয়েছে হু হু করে। যা বিক্রি হচ্ছে সবই এগরোল। তাতেও বিঁধে থাকছে সন্দেহের কাঁটা— ‘‘কী জানি বাবা কী মিশিয়ে দিয়েছে’’, বলছেন অনেকেই!

চন্দনগরের এক খাবারের দোকানের মালিক তাবরেজ আলম বলেন, ‘‘ছোট দোকান, থাকিও এই এলাকায়। এখানে কি ওই সব নোংরা মেশানো সম্ভব! আমাদের সকলেই চেনেন, তবু লোকে সন্দেহ করছেন। মুখে না বললেও বেশির ভাগ ক্রেতাই এড়িয়ে যাচ্ছেন।’’ তাবরেজের দোকানেই ক’দিন আগে তিন হাড়ি বিরিয়ানি উবে যেত কয়েক ঘণ্টায়। এখন এক হাঁড়ির অর্ধেকও বিক্রি হচ্ছে না বলে তাঁর দাবি।

Advertisement

গত কয়েক বছরে হুগলির বিভিন্ন ছোট-বড় শহরে তৈরি হয়েছে একাধিক বিরিয়ানির দোকান। সস্তায় সেই সব মুরগি বা খাসির মাংস দেওয়া বিরিয়ানির স্বাদ নিয়ে কোনও দিন প্রশ্ন তোলেননি ক্রেতারা। এমনকী অনেককেই বাড়িতে অতিথি এলে গর্ব করে বলেছেন, ‘‘আমাদের পাড়ার অমুক দোকানের বিরিয়ানি খেয়ে দেখ। কলকাতার অমুক রেস্তরাঁর মতোই স্বাদ।’’ তাঁরা অনেকেই আর সাহস করছেন না বাড়িতে এক প্যাকেট বিরিয়ানি আনতে।

আদিসপ্তগ্রামের বাসিন্দা শোভনলাল ঘোষ বলেন, ‘‘মাংস ছাড়া যেন জীবনটা ভাবতেই পারতাম না। কিন্তু এখন তো দোকান থেকে কাঁচা মাংস কিনতে গেলেও দেখতে হচ্ছে জ্যান্ত কিনা। বিরিয়ানি আর খাই কী করে?’’ ব্যান্ডেলের বাসিন্দা নম্রতা প্রামাণিকও বলেন, ‘‘খাবার কিনতে গেলে একটু চিন্তা করতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এতদিন কী খেয়েছি— তা ভাবলেও তো গা গোলাচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি হওয়া দরকার।’’

ক্রেতাদের এমন মনোভাবে মাথায় হাত ব্যান্ডেলের বিরিয়ানি ব্যবসায়ী সাহিদ আনসারি, চুঁচুড়ার বাপি দাসদের। তাঁরাও দাবি করলেন, তাঁরা জ্যান্ত পশু কেটে তবে বিরিয়ানি বানান। বাপি বলেন, ‘‘আমাদের তো আপনারা চেনেন। মেলা-টেলার সময় যাঁরা অস্থায়ী দোকান দেয় তাঁরা কী করে তা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের নিয়ে এত উদ্বেগ কেন?’’

তবে বিশ্বাস তেমন জমছে না ক্রেতাদের মধ্যে। বৈশাখের ভরা বিয়ের মরসুমেও মেনুতে মাংস নিয়ে চিন্তিত বাঙালি। অনেকই বিরিয়ানি রেখেছিলেন মেনুতে। হঠাৎই বাদ পড়েছে তা। অনেকেই কেটারিং সংস্থার মালিককে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন, মুরগি বা খাসি কিনে দেবেন তাঁরা। চুঁচু়ড়ার একে কেটারিং সংস্থার মালিক স্বপন সামন্ত বলেন, ‘‘এমনিতেই গরম পড়ছে, তার উপর এই ভাগাড়-কাণ্ড— দু’তিনটি বিয়ে বাড়ি থেকে বিরিয়ানির বরাত বাতিল হয়েছে। অনেকেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাঁদের চোখের সামনে মাংস কেটে রান্না করতে হবে। বিশ্বস্ততা বজায় রাখতে গিয়ে আমাদের কাজ বাড়ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন