আধুনিক যন্ত্রের অভাবে সঙ্কটে উদয়নারায়ণপুরের তাঁতশিল্প

সেই পুরনো হস্তচালিত তাঁত। আধুনিক যন্ত্রচালিত তাঁতের সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। কারণ টাকার অভাব। মেলেনি সরকারি সাহায্যও। তদুপরি নতুন প্রজন্ম এই শিল্প থেকে মুখ ফেরানোয় বাজারের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দূরস্থান, অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে উদয়নারায়ণপুরের তাঁতশিল্পীদের। শিল্পীদের দাবি, এই ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই উদয়নারায়ণপুর থেকে হারিয়ে যাবে তাঁতশিল্প।

Advertisement

মনিরুল ইসলাম

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৪ ০১:০৭
Share:

শাড়ি বুনতে ব্যস্ত তাঁতশিল্পী। ছবি: সুব্রত জানা।

সেই পুরনো হস্তচালিত তাঁত। আধুনিক যন্ত্রচালিত তাঁতের সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। কারণ টাকার অভাব। মেলেনি সরকারি সাহায্যও। তদুপরি নতুন প্রজন্ম এই শিল্প থেকে মুখ ফেরানোয় বাজারের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দূরস্থান, অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে উদয়নারায়ণপুরের তাঁতশিল্পীদের। শিল্পীদের দাবি, এই ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই উদয়নারায়ণপুর থেকে হারিয়ে যাবে তাঁতশিল্প।

Advertisement

হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুরের হরালি, গঞ্জা, পেয়ারাপুরের এক সময় রমরমা ছিল তাঁতশিল্পে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন এই শিল্প মূলত নির্ভর হয়ে পড়েছে যন্ত্রচালিত তাঁতে তখন এই সব এলাকার শিল্পীরা থেকে গিয়েছেন সাবেক পদ্ধতিতেই। সেই পুরনো চরকায় সুতো কাটা। তার পর ডবি মেশিনের সুতোর সঙ্গে সুতো সাজিয়ে তাঁতের শাড়ি, ধুতি, ধুতি-সহ বিভিন্ন বস্ত্র আজও তৈরি করে চলেছেন এখানকার তাঁতশিল্পীরা। এতে স্বাধীনতার আগের সেই স্বদেশিয়ানা বজায় থাকলেও তা যে বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় তা বুঝতে পেরেছেন স্থানীয় তাঁতশিল্পীরা। কিন্তু বুঝতে পারলেও আর্থিক অভাবে পিছিয়ে গিয়েছেন তাঁরা।

শিল্পীরা জানান, বাজার থেকে সুতো কিনে এনে সেই সুতো রং করা, চরকায় সুতো কাটা থেকে শুরু করে নানা পদ্ধতি পেরিয়ে একটা তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে সময় লেগে যায় পুরো একটা দিন। তা থেকে যা মজুরি পাওয়া যায় তাতে পোষায় না। তা ছাড়া সাবেক পদ্ধতিতে উৎপাদনের হারও অত্যন্ত কম। অন্যদিকে, আধুনিক যন্ত্রচালিত তাঁতে উৎপাদনের হার তুলনায় বেশি। মজুরিও বেশি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এখানকার তাঁতশিল্পীরা যন্ত্রচালিত তাঁতশিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না। পাশাপাশি শিল্পের এমন অবস্থা দেখে বহু শিল্পী নিজেদের ছেলেমেয়েদের এই শিল্পে আসতে দিতে চাইছেন না। ফলে যা অবস্থা, তাতে অস্তিত্ব রক্ষা করাই ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

হরালির প্রবীণ তাঁতশিল্পী নির্মল পোড়েল, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, কালিপদ হাজরা বলেন, “সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রোজগার হয় মাত্র একশো টাকা। তা ছাড়া একটা শাড়ি তৈরির পিছনে পরিবারের মেয়েদেরও অবদান থাকে। তাঁদের পারিশ্রমিক ধরলে গড়ে ৪০ টাকাও থাকে না। এই অবস্থা শিল্প তো দূর, বেঁচে থাকাই সমস্যা। ফলে অনেকেই অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। চলে যাচ্ছেন আরও অনেকে।”

এলাকার তাঁতশিল্পীদের স্বার্থে ২০০৯-’১০ হরালি, গঞ্জা, পেয়ারাপুরে তৈরি হয়েছিল হ্যান্ডলুম ক্ল্যাস্টার। ঠিক হয়েছিল এর মাধ্যমে তাঁতশিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, তাঁদের আর্থিক সাহায্য করা, উৎপাদিত পণ্যের বিপণনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এলাকায় প্রায় এগারোশো তাঁতশিল্পী থাকলেও এতদিনে ক্লাস্টারের সদস্য হয়েছে মাত্র সাড়ে তিনশো জন। সদস্য হননি, এমন এক তাঁতশিল্পীকে কারণ জানতে চাইলে তাঁর উত্তর, ক্লাস্টার তৈরি হলেও তাঁতশিল্পীদের সেই পুরনো পদ্ধিতেই প্রশিক্ষণ, সাবেক যন্ত্রপাতি ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন আসেনি। শিল্পীদের প্রশিক্ষণ হয় সেই পুরনো কাঠের ডবিতে। নেই আধুনিক ব্যবস্থাপনা বা বিপণনের ব্যবস্থা। তার বদলে যদিও শিল্পীদের যন্ত্রচালিত তাঁতে প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে আর্থির সহায়তার ব্যবস্থা রত তাতে শিল্পীদের উপকার হত।

হরালি হ্যান্ডলুম ক্ল্যাস্টার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সম্পাদক পি জানা বলেন, “এলাকায় তাঁতশিল্পীর সংখ্যা যেখানে এগারোশোর কাছাকাছি, সেখানে সোসাইটির সদস্য মাত্র ৩৫০। পুঁজির অভাবে দিন দিন এই শিল্পে শিল্পীর সংখ্যা কমছে। সরকারি সাহায্য নেই। ফলে সঙ্কটের মুখে এখানকার তাঁতশিল্প।” তিনি আরও জানান, এক সময় এই উদয়নারায়ণপুরে প্রায় ১০ হাজার তাঁকশিল্পী ছিলেন। কিন্তু অবস্থার কারণে এখন তা প্রায় তিন হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।

তাঁতশিল্পীদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের প্রতি বারবার নজর দেওয়ার কথা বললেও কার্যত তা যে হচ্ছে না, উদয়নারায়ণপুরের তাঁতশিল্পের বর্তমান চেহারাই তার প্রমাণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন