কারও পৌষ মাস তো কারও সর্বনাশ।
হাওড়ায় পাঁচটি পুরসভা গঠনের ঘোষণা সাধারণ মানুষকে খুশি করলেও, জেলা পরিষদের কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। কারণ পুরসভা গঠন হলে পঞ্চায়েতের এলাকা অনেকটাই কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে জেলা পরিষদের উপর। কারণ ওইসব এলাকা থেকে জেলা পরিষদের আয় কমে যাবে অনেকটাই। গত আর্থিক বছরেও হাওড়া জেলা পরিষদ নিজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দফতর থেকে সেরার পুরষ্কার পেয়েছে। কিন্তু আয়তন ছোট হয়ে গেলে নিজস্ব আয় বৃদ্ধির এই হার কতটা বজায় রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে জেলা পরিষদের কর্তাদের মধ্যে।
জেলা পরিষদের বর্তমানে আয়ের উৎসগুলি হল বাড়ি এবং কারখানার নির্মাণের অনুমতি দেওয়া থেকে কর, ফেরিঘাট, দোকান এবং বাজারের অংশ লিজ বাবদ কর প্রভৃতি। তবে এগুলির মধ্যে প্রধান হল বাড়ি এবং কারখানা থেকে আয়। পঞ্চায়েত এলাকা কমে গেলে স্বাভাবিক ভাবে আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে মূলত এই ক্ষেত্রেই।
কী ভাবে?
হাওড়া জেলায় বালি-জগাছা, সাঁকরাইল, ডোমজুড়, পাঁচলা, উলুবেড়িয়া ১ এবং ২ ব্লকের প্রায় দেড়শো গ্রাম পঞ্চায়েত পড়ে কেএমডিএ এলাকায়। এইসব এলাকায় বাড়ি এবং কারখানার ঘর তৈরি করতে হলে অনুমতি নিতে হয় জেলা পরিষদের কাছে। অনুমতি দেওয়ার জন্য কর নিয়ে থাকে জেলা পরিষদ। এই সব এলাকা জুড়ে এখন বহুতল তৈরির রমরমা। এ ছাড়াও তৈরি হচ্ছে নিত্য নতুন কারখানা। এর সুবাদে জেলা পরিষদের আয়ের ক্ষেত্রও দিন কে দিন বেড়েছে। কিন্তু আন্দুল, ডোমজুড় এবং বালি উত্তর এই তিনটি পুরসভা গঠনের জন্য পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের সিদ্ধান্তের কারণে জেলা পরিষদের আয়ের ভাঁড়ারে কোপ পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই তিন পুরসভা গঠিত হলে তা হবে শহর লাগোয়া পঞ্চায়েতগুলিতেই। আর এইসব এলাকাতেই ক্রমবর্ধমান হারে বহুতল এবং কারখানা তৈরি হচ্ছে। পুরসভায় পরিণত হলে এইসব এলাকায় বাড়ি বা কারখানার নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা হারাবে জেলা পরিষদ। তার পরিবর্তে ওই অনুমতি দেওয়ার কাজ করবে পুরসভাগুলি। এ বাবদ করের টাকাও জমা পড়বে তাদের ঘরেই। ফলে ডোমজুড়, সাঁকরাইল, পাঁচলা এবং বালি-জগাছা ব্লকের অধিকাংশ পঞ্চায়েতকে নিয়ে তৈরি তিন পুর এলাকা থেকে আয়ের সিংহভাগই হাতছাড়া হবে জেলা পরিষদের।
আয়ে টান পড়ার এই অনিবার্যতা মেনে জেলা পরিষদের কর্তাদের বক্তব্য, শহর লাগোয়া এইসব পঞ্চায়েতগুলিতে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের প্রকল্পগুলি চালানো হত নাম কা ওয়াস্তে। বিশেষ করে ১০০ দিনের প্রকল্প এইসব এলাকায় রূপায়িত করা কার্যত অসম্ভব ছিল। প্রথমত মাটির জন্য জমির অভাব এবং এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে মজুরদের অনীহা। এ কথা মেনে নিয়েছেন জেলা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের আধিকারিকেরাও। ১০০ দিনের প্রকল্প রূপায়ণে ডোমজুড়, সাঁকরাইল এবং বালি জগাছা এই তিন ব্লকের সব থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসাবে তাঁরা জানান, শহর ঘেঁষা হওয়ায় ১০০ দিনের প্রকল্প রূপায়ণের শর্তগুলি পূরণ করা যায়নি। শুধু তাই নয়, এইসব এলাকায় নিকাশি, পানীয় জল এবং অন্যান্য সমস্যা মেটাতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা জোগাড় করা পঞ্চায়েতের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও জেলা পরিষদের এক কর্তা জানান, নগরায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পঞ্চায়েত এলাকাগুলির পুরসভায় পরিণত হওয়া উন্নয়নের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নিজেদের আয় কমে যাবে এই যুক্তি দেখিয়ে সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার গতি রোধ করা যায় না।
এই অবস্থায় শহর ঘেঁষা পঞ্চায়েতগুলি হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আয় বাড়ানোর বিকল্প উপায়ের খোঁজে নেমে পড়েছেন জেলা পরিষদের কর্তারা।
জেলা পরিষদ সূত্রের খবর, বিকল্প উপায়ে আয় বাড়ানোর ভাবনার মধ্যে যে যে বিষয় রয়েছে তা হল , ফেরিঘাটগুলিতে পরিষেবার মানের উন্নতি। যেমন জেটিঘাট তৈরি করা, জেটিঘাটে শৌচাগারের ব্যবস্থা করা, জেলা পরিষদের বহু জায়গা দখলমুক্ত করে তা আইনসঙ্গতভাবে লিজ দেওয়া, গড়চুমুক হরিণ প্রকল্পকে লাভজনকভাবে গড়ে তোলা, সামতাবেড়েয় শরৎচন্দ্রের জন্মভিটাকে কেন্দ্র করে সার্কিট ট্যুরিজম প্রকল্প গড়ে তোলা, জেলা পরিষদের নিজস্ব উদ্যোগে বাণিজ্যিক ভবন গড়ে তোলা প্রভৃতি।
জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি অজয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে গেলে মানুষকে উন্নত পরিষেবা দিতে হবে। পরিষেবার মান বাড়ালে বদলে যাবে জেলার চেহারাও। সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।”