চলছে মাদুর বোনা। ছবি: সুব্রত জানা।
একদিকে কাঁচামালের জোগানের অভাব, অন্য দিকে নেই যথাযথ বিপণন ব্যবস্থা। দু’য়ের মাঝে পড়ে প্রায় উঠে যেতে বসেছে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের ঐতিহ্যবাহী মাদুর-শিল্প। জীবিকার নিরাপত্তার আশঙ্কায় দিন কাটছে এই অঞ্চলের কয়েক হাজার মাদুরশিল্পীর।
শিল্পীদের দাবি বাজারে চাহিদা থাকলেও তাঁরা বেশি পণ্য তৈরি করতে পারছেন না। পাশাপাশি যে পণ্য তাঁরা উত্পাদন করছেন সেগুলো বিক্রির জন্য বড় কোনও বাজার বা বিপণন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। ফলে তাঁদের নির্ভর করতে হচ্ছে মহাজনদের উপর। কম দামে তাঁরা পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছেন মহাজনদের কাছে। দিনরাত পরিশ্রম করে যে পণ্য তাঁরা উত্পাদন করছেন, তার ন্যূনতম দাম পেতেই ঘাম ছুটছে শিল্পীদের। এই অবস্থায় এক সময় রমরমিয়ে ব্যবসা করা মাদুরশিল্পীরা আজ দুর্দশায়। মাদুরশিল্পের এই বেহাল অবস্থার কারণে নতুন প্রজন্মের ছেলেরাও এই শিল্পে উত্সাহ হারাচ্ছেন বলেও শিল্পীদের দাবি। ফলে এই শিল্পের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কিত শিল্পীরা। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি তরফে যদি বাজার তৈরি করা হয় ও বিপণনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় তাহলে এই শিল্পের দিন ফিরবে। তবে একই সঙ্গে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি প্লাস্টিকের মাদুর বাজারে এসে যাওয়ায় ও কাঠির তৈরি মাদুরের বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছে বলে শিল্পীরা মনে করছেন। কারণ কাঠির মাদুরের তুলনায় প্লাস্টিকের মাদুরের আয়ু বেশি। যদিও তাঁদের দাবি, বিভিন্ন জায়গা ঘুরে তাঁরা দেখেছেন ঘর সাজানো থেকে, নানা রকম হস্তশিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাঠির মাদুরের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত বাজার বা বিপণন ব্যবস্থা না থাকায় সেই বাজার তাঁরা ধরতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে বিডিও সুরজিত ঘোষ বলেন, “মাদুরশিল্পীদের তৈরি পণ্য কেনা-বেচার জন্য মনসুকাতে একটা ছোটখাটো হাট রয়েছে। সেখানেই তাঁরা মালপত্র বিক্রি করেন। তবে শিল্পীদের কোনও সমস্যা থাকলে তাঁরা জানাদেত পারেন। এমনকী তাঁদের কোনও পরিকল্পনা থাকলেও তা তাঁরা জানাতে পারেন। তা হলে জেলা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতরের সঙ্গে সে ব্যাপারে আলোচনা করব।”
জেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতরের আধিকারিক অশোক সিংহ রায় বলেন, “মাদুর শিল্পীদের এমন সমস্যার কথা কেউ জানাননি। শিল্পীরা যদি তাঁদের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে এলে অবশ্যই তা নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।”
এলাকার গড় ভবানীপুর, মনসুকা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় হাজার দুয়েকের বেশি মাদুরশিল্পী রয়েছেন। তাঁদের তৈরি শৌখিন মাদুরের কদরও রয়েছে বাজারে। হাওড়া জেলা তো বটেই, হুগলি, মেদিনীপুর-সহ অন্যান্য জেলা এমনকী রাজ্যের বাইরে এবং বিদেশেও এখানকার মাদুরের চাহিদা রয়েছে বলে শিল্পীদের দাবি। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে মাদুরশিল্পীরা সেই বাজার ধরতে পারছেন না। শিল্পীরা জানান, মনসুকা-কানুপাট, ভবানীপুর-সহ মাত্র কয়েকটি জায়গায় মাদুর কাঠির চাষ হয়। কিন্তু মাদুরের বাজার সে ভাবে না বাড়ায় চাষিরাও মাদুরকাঠির চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে কাঠির অভাবের পাশাপাশি বেশি দামও গুনতে হচ্ছে তাঁদের।
মনসুকার এক মাদুরশল্পী ভোলা পাখিরা বলেন, “এক জোড়া মাদুরকাঠি কিনতে সাড়ে তিনশো টাকা পড়ে। তার পর দড়ি দিয়ে মাদুর বুনতে ও রং করতে হয়। এক জোড়া কাঠিতে তিনটি মাদুর তৈরি হয়। মোট ৪০০ টাকার বেশি খরচা হয়। তিন দিন সময় লাগে। অথচ তা বিক্রি হয় মাত্র ৬০০ টাকায়। দিনে মেরেকেটে ৬০ থেকে ৭০ টাকা আয় হয়। এ ভাবে আর চালানো যাচ্ছে না।” এই অবস্থায় অনেক শিল্পীই দিনমজুরের কাজও কাজ করছেন। ভোলাবাবুর মতোই অবস্থা মনোরঞ্জন পাখিরা, রঞ্জন ধাড়া-সহ অন্য শিল্পীদের। তাঁদেরও দাবি, সরকারি উদ্যোগে যদি বাজার এবং কাঁচা মালের জোগানের ব্যবস্থা হয় তাহলেই এই শিল্পের উন্নতি হবে।