একদিকে বাইরের সমাজবিরোধী আর অন্যদিকে এলাকার পরিচিত দুষ্কৃতী--এই দু’য়ের সাঁড়াশি চাপে এখন চিঁড়েচ্যাপ্টা জেলা সদরের বির্স্তীণ এলাকার মানুষ।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, এলাকার দু-আনা, চার আনার শাসকদলের নেতারাও হয়ে উঠেছে সেই সব সমাজবিরোধীদের ছাতা। সেই ছাতা এতটাই ‘ভরসা’র যে পুলিশ প্রশাসন নড়ে বসতে সময় নিচ্ছে। পুলিশ ব্যবস্থা নিতে একান্ত বাধ্য হলে সরাসরি জেলার এক ডাকাবুকো বিধায়কের নামে আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে সদরের এলাকার আইন শৃঙ্খলা লাটে উঠেছে।
মাস কয়েক আগে চুঁচুড়ার একটি বাজারে সন্ধ্যায় দুষ্কৃতীরা মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে গুলি চালাতে চালাতে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে পড়তে লাগল বোমা। আতঙ্কগ্রস্ত দোকানদাররা ঝুপ-ঝাপ দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিতে শুরু করলেন। ভরা বাজারে উপস্থিত মহিলা, অল্প-বয়স্করা ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন ভয়ে। বাজারে স্কুলের খাতা কিনতে আসা এক ছাত্রীর পায়ে গুলি লাগল। তাণ্ডব করে কাজ সেরে দুষ্কৃতীরা পালানোর পর দেখা গেল এক দুষ্কৃতীর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ বাজারে পড়ে। প্রথমে সেই দুষ্কৃতীর পরিচয় পুলিশ উদ্ধার করতে না পরালেও পরে তদন্তে জানা গিয়েছে, নিহত ওই দুষ্কৃতী উত্তর ২৪ পরগনার।
চুঁচুড়ার দীর্ঘদিনের এক বাসিন্দার অভিযোগ, ব্যান্ডেল, হুগলি, চুঁচুড়া স্টেশন রোড এলাকায় এখন মূলত শাসকদলের ছেলেরাই জমি-বাড়ির ব্যবসার দখল নিয়েছে। ফলে পুলিশ থেকে প্রশাসন, একেবারে মুফতেই সহযোগিতা মিলছে। যার ফলে ক্রমাগত দুষ্কৃতীদের ভিড় বাড়ছে দলের ছাতার তলায়।
শাসকদল হলেই এক ঢিলে অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। জমির মালিক যেমন ভয় পাচ্ছেন, পাশাপাশি পুলিশ পুরসভা বা পঞ্চায়েতের মাথা পর্যন্ত মিউটেশনের কোনও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। এমনকী পরিবেশের তোয়াক্কা না করে সহজেই এলাকার পুকুর বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। প্রতিবাদ যে নেই তা নয়। তবে তার স্বর এতই ক্ষীণ যে, মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।
হিড্ডা, লালা, টোটন, সঞ্জীব এমন সব নামের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকা। একদিকে দু’ভাই তো অন্যদিকে বাকিরা। তাদের আমন্ত্রণে নদিয়ার কুপার্স ক্যাম্প, উত্তর ২৪ পরগনার নোয়াপাড়া, জগদ্দল, খড়দা থেকেও দুষ্কৃতীরা ঈশ্বরগুপ্ত সেতু হয়ে মগরায় হয়ে চুঁচুড়া হুগলিতে ঢুকছে। পুলিশের নজর এড়াতে অনেক সময় জল পথে নৌকাতেও হানা দিচ্ছে। এপারে কাজ মিটিয়ে ফের নিরাপদ ডেরায় ফিরে যাচ্ছে ওপারে। জেলা বদলের রসায়নে পুলিশের দেরিতে নড়াচড়ায় অনেকটাই সময় পেয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা।
জেলের বাইরে প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা তৈরি হলে এলাকার রাজনৈতিক দাদারাই থানার দোরগোড়া পর্যন্ত দুষ্কৃতীদের পৌঁছে দিচ্ছে। জেলা পুলিশের বড় কর্তাদের কাছে রাজনৈতিক কর্তব্য পালনের নমুনা পেশ করছে। ফের আদালত থেকে জামিন পেয়ে এলাকায় ছড়ি ঘোরাচ্ছে ওই দুষ্কৃতীরা।
এক সময় চুঁচুড়ায় দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াত এলাকার বাসিন্দা বাম আমলের ডাকাবুকো এক সাংসদের ছত্রচ্ছায়ায়। এখন সে রামও নেই আর রাজত্ব কবেই গিয়েছে। তাই মানিক এখন এলাকা ছাড়া। এলাকায় একটা বড় মাছ যেমন অন্যদের দাপিয়ে রাখে বামেদের এক আইনজীবীর আড়ালে মানিক সেই আমলে বহাল তবিয়তে ছিল। কেউ মাথা তুলতে সাহস পেত না। তৎকালীন শাসকদলের দাপটে অন্যরা অনায়াসে চাপা পড়ে যেত। কিন্তু ক্ষনতার বদল হতেই চুঁচুড়া, ব্যান্ডেল আর হুগলি স্টেশন রোডে সমাজবিরোধীদের সমীকরণটাই বদলে গিয়েছে।
দলের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ায় সমাজবিরোধীরাও বহু নেতার ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়ে নানা দল আর উপদলে ভাগ হয়ে গিয়েছে। জেলা পুলিশের হাতে ধরা পড়া এক দুষ্কৃতী তো একবার পুলিশের কাছে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিল। সরাসরি শাসকদলের এক নেতার নাম করে সে বলে তাকে লক্ষাধিক টাকা টিপ দেওয়া হয়েছিল অন্য দলের নেতাকে নিশানা করতে।
অবশ্য এ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন চুঁচুড়ার তৃণমূল বিধায়ক তপন মজুমদার। তাঁর সাফ জবাব, “দলের নির্দেশ আছে কেউ কোনও অনৈতিক কাজে বা সরাসরি প্রোমোটারি, ঠিকাদারি কাজ করতে পারবে না। সেই কাজে জড়িত থাকলে তাঁকে দল ছাড়তে হবে। আমি নিজে চুঁচুড়ায় সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মিছিল করেছি। পুলিশকে সর্তক থাকতে বলেছি।” সমাজবিরোধীদের দাপট বাড়া নিয়ে তাঁর যুক্তি, “চুঁচুড়া এখন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটতেই পারে। তবে তা লাগাম ছাড়া কখনই নয়।”
বিধায়ক আশ্বস্ত করলেও বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। এলাকার একটি সিনেমা হল বিক্রি নিয়ে যে আকচা-আকচি শাসকদলের মধ্যে শুরু হয়েছে তা কিন্তু এখনও ছাইচাপা আগুন।
(চলবে)