অনিন্দিতা সেন ও ঈশিতা। —নিজস্ব চিত্র।
দিন পেরোলেই জীবনের আর একটি বছর পূর্ণ হত তার। বয়স হত ছয়। কিন্তু তা আর হল কই! জন্মদিনের এক দিন আগেই বেপরোয়া লরি প্রাণ কেড়ে নিল ছোট্ট মেয়েটির। সেই সঙ্গে কেড়ে নিল হাওড়ার শেখপাড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবারের সমস্ত আশা-আকাঙ্খা আর আনন্দ।
কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনায় মৃত ঈশিতার জন্মদিন ছিল আজ, শুক্রবার। ছ’বছরে পা দিত কলকাতার একটি স্কুলের আপার কেজির ছাত্রী ঈশিতা। মা কর্মসূত্রে হাওড়ার একটি স্কুলের শিক্ষিকা হওয়ায় জন্মের পর থেকেই মায়ের সঙ্গে শেখপাড়ার মামার বাড়িতে থেকে বড় হচ্ছিল সে। বাবা রেলের পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার সিদ্ধার্থ সেন নিজের বাড়ি নিউ আলিপুর থেকেই বেলুড়ের রেল অফিসে যাতায়াত করেন। এ দিন সকালে মামার বাড়ি থেকেই মা ও বাড়ির কাজের লোক পুষ্পর সঙ্গে স্কুলে রওনা দিয়েছিল ঈশিতা।
বাবা-মার একমাত্র সন্তান ও দাদু-দিদিমার আদরের একমাত্র নাতনির জন্মদিনের জন্য কেনাকাটাও প্রায় হয়ে গিয়েছিল। কেনা হয়েছিল নতুন জামা ও সোয়েটার। ঠিক ছিল রাতেই দাদু-দিদিমার সঙ্গে বসে কেক কেনা-সহ অন্যান্য খাওয়া-দাওয়ার পরিকল্পনা হবে। কিন্তু তার আগেই শেখপাড়া লেনের বাড়িতে এসে পৌঁছল ওই দুঃসংবাদ।
বাড়িতে তখন মেয়ে ও নাতনির আসার অপেক্ষায় ছিলেন দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। দাদু অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক অফিসার কৃষ্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং দিদা রুনা মুখোপাধ্যায়। এ দিন বাড়িতে বসে রুনাদেবী জানান, ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা পর তাঁদের কাছে খবর আসে বাড়ির কাছেই কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে নাতনি ঈশিতা, মেয়ে অনিন্দিতা ও দীর্ঘ দিনের কাজের লোক পুষ্প। নাতনি ও পুষ্পকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাওড়া জেলা হাসপাতালে। জামাইকে ফোনে ঘটনাটি জানিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন কৃষ্ণচন্দ্রবাবু। কিছুক্ষণ পরেই রুনাদেবীর কাছে পৌঁছয় নাতনি ও পুষ্পর মৃত্যুসংবাদ। জানতে পারেন গুরুতর আহত অবস্থায় এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁদের একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতাকে। পরে খবর আসে মৃত্যু হয়েছে মেয়েরও।
দুর্ঘটনায় পাড়ারই একটি পরিবারের মা, মেয়ে ও কাজের লোকের মৃত্যু সংবাদ রটে যাওয়ার পরই মুখোপাধ্যায় পরিবারের দোতলা বাড়ির সামনে ভেঙে পড়ে গোটা পাড়া। খবর পেয়ে ছুটে আসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরাও। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে বাক্রুদ্ধ হয়ে গেলেও পরে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে রুনাদেবী জানান, সকাল ৭টায় বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিন জন। নাতনির স্কুলে ছুটি ছিল। কিন্তু এ দিন স্পোর্টস থাকায় ঈশিতার সঙ্গে অনিন্দিতা ও পুষ্পা গিয়েছিলেন। সাড়ে ১১টার মধ্যে ফেরার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু ফিরলেন না কেউই, পরিবর্তে দিনভর এল মৃত্যুর খবর।
রুনাদেবী বলেন, “একদিন বয়স থেকে নাতনিকে মানুষ করেছি। এ দিন দেখতে হবে ভাবতে পারিনি। আমাদের কী রইল! সব শেষ হয়ে গেল!”