বর্ধমান থেকে বাজনদার আসত কর-বাড়ির পুজোয়

আজকের দিনে চতুর্দিকে বারোয়ারি দুর্গাপুজোর রমরমা। পাড়ায় পাড়ায় পুজো দেখতে ঢল নামে মানুষের। আগে অবশ্য এমনটা ছিল না। তখনকার দিনে বনেদি বাড়ি বা জমিদার বাড়ির পুজোকে ঘিরেই আবর্তিত হত বাঙালির সেরা উৎসবের আনন্দ।

Advertisement

প্রকাশ পাল

ধনেখালি শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৩৮
Share:

আজকের দিনে চতুর্দিকে বারোয়ারি দুর্গাপুজোর রমরমা। পাড়ায় পাড়ায় পুজো দেখতে ঢল নামে মানুষের। আগে অবশ্য এমনটা ছিল না। তখনকার দিনে বনেদি বাড়ি বা জমিদার বাড়ির পুজোকে ঘিরেই আবর্তিত হত বাঙালির সেরা উৎসবের আনন্দ। গ্রামবাংলার প্রাচীন সে সব বাড়ির পুজোর কালক্রমে অনেকটাই বদল হয়েছে। তবে পুজো আয়োজনের ধরণ-ধারণ একই রয়ে গিয়েছে। হুগলির ধনেখালির কাঁকড়াকুলি কর বাড়ির পুজো তারই অন্যতম। সে যুগের ঠাকুর দালানে যাবতীয় আচার মেনে দেবীর আরাধনা চলে।

Advertisement

ধনেখালির সোমসপুর ২ পঞ্চায়েতের অভিজাত এই পারিবারিক পুজোটি প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য এক সময় এই গ্রামের যথেষ্ট নাম ডাক ছিল। বাড়ির লোকজনের দাবি, পরিবারের কর্তা শ্রীনিবাস কর এই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। প্রাচীনত্বের কারণে দেবী দুর্গা এখানে ‘বুড়িমা’ নামে অভিহিত। পরিবারের বর্তমান সদস্যদের বক্তব্য, শ্রীনিবাস ভাগ্যান্বেষণে বের হয়ে কৌশিকী ও ঘোলাই নদীর সঙ্গমস্থলে দেবী সিদ্ধেশ্বরীর পীঠস্থানে উপস্থিত হন। তাঁর তখন বৈরাগীর বেশ। এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাঁকে দেখে বলেন, তাঁর এখনও বৈরাগ্যের সময় হয়নি। তিনি যেন বিয়ে করে সংসারী হন। ওই পণ্ডিতের উপদেশে শ্রীনিবাস বিয়ে করেন। কাঁকড়াকুলিতে থাকতে শুরু করেন। ওই গ্রাম তখন জঙ্গলাকীর্ণ, প্রায় জনহীন। শ্রীনিবাস আসার পরেই এখানে আরও অনেক বিদ্বান মানুষ এসে বাসা বাঁধেন। তখন থেকেই সাহিত্য-দর্শন চর্চায় এই গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়ে।

গ্রামের এক সময়ের বাসিন্দা, স্কুল-শিক্ষক অচিন সিংহরায় কর বাড়ির পুজোর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেছেন। তিনি জানান, শ্রীনিবাসের প্রতিষ্ঠিত বুড়িমার পুজো বংশানুক্রমিক ভাবে করে এসেছেন স্থানীয় ভট্টাচার্য পরিবার। শ্রীনিবাস নিজে শাক্ত ছিলেন। ফলে সেই মতেই দেবীর পুজো হত। ছাগ বলির ববস্থা ছিল। কুল পুরোহিতের অবর্তমানে পরে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী যোগেন ভট্টাচার্য পুজোয় ব্রতী হন। তখন থেকে পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। তার পরিবর্তে ছাঁচিকুমড়ো বলির প্রচলন হয়। সেই প্রথাই আজও চলে আসছে। কারা-নাকারা, ঢুলি, বাজনদাররা আসতেন বর্ধমান পরগনার একলাকী কুমারগঞ্জ থেকে। গত কয়েক বছর ধরে অবশ্য আর আসেন না। পরম্পরা মেনেই সাবেকি একচালার প্রতিমা তৈরি হয়।

Advertisement

পরিবারের বর্তমান সদস্যদের কেউ কেউ এখনও গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। বাকিরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। তবে পুজোর চারটে দিন সকলেই ধনেখালির প্রত্যন্ত ওই গ্রামের বাড়িতে আসেন। কর পরিবার ৮৭ বছরের শক্তিপদ রায়ের মামার বাড়ি। কলকাতা নিবাসী শক্তিপদবাবু বললেন, “জন্মের পর এক বছরও এমন হয়নি যে পুজোয় কাঁকড়াকুলি যাইনি। এ বারও যাব।” শক্তিপদবাবুর কথায়, “পুজোর ক’টা দিন বাড়ির সকলের মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে।”

নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে পুজোর পাশাপাশি দেদার আড্ডা, পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া চলে ওই চার দিন। বয়স্করা ফিরে যান ছেলেবেলায়। পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্য সৌরভ করের কথায়, “পুরনো ঐতিহ্য যাতে একটুও না বদলায়, আমরা সেই চেষ্টাই করি। পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে যাই ওই ক’টা দিন। গ্রামের মানুষ ঠাকুর দেখতে আসেন আমাদের বাড়িতে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন