ভাণ্ডারা লুঠের প্রতীক্ষায় গুপ্তিপাড়া

একটা-দু’টো মালসা নয়, সংখ্যায় চারশোরও বেশি। মাটির এক-একটা মালসায় প্রায় পাঁচ কিলো খাবার, থুড়ি, জগন্নাথের প্রসাদ। লুঠ করতে হবে সে সব! প্রাচীন প্রথামতো উল্টোরথের আগের দিন হয় ‘ভাণ্ডারা লুঠ’। এই লুঠ আর রথযাত্রার দিন গুনছে হুগলির গুপ্তিপাড়া।

Advertisement

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৫ ০২:৩৪
Share:

গুপ্তিপাড়ায় রথযাত্রা। —ফাইল চিত্র।

একটা-দু’টো মালসা নয়, সংখ্যায় চারশোরও বেশি। মাটির এক-একটা মালসায় প্রায় পাঁচ কিলো খাবার, থুড়ি, জগন্নাথের প্রসাদ। লুঠ করতে হবে সে সব! প্রাচীন প্রথামতো উল্টোরথের আগের দিন হয় ‘ভাণ্ডারা লুঠ’। এই লুঠ আর রথযাত্রার দিন গুনছে হুগলির গুপ্তিপাড়া।

Advertisement

‘ভাণ্ডারা লুঠ’-এর নেপথ্যে পৌরাণিক এক প্রেম কাহিনী রয়েছে বলে জানালেন গুপ্তিপাড়া শ্রী শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রজিউ মঠের প্রশাসক মহন্ত স্বামী গোবিন্দানন্দ পুরি। তাঁর দাবি, লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় জগন্নাথ লুকিয়ে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেন। লক্ষ্মী ভাবলেন, স্বামী পরকীয়ার টানে পালিয়েছেন। বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারলেন জগন্নাথ রয়েছেন মাসির বাড়িতে। স্বামীর মতিস্থির করাতে লক্ষ্মী লুকিয়ে ওই বাড়িতে ‘সর্ষে পড়া’ ছিটিয়ে আসেন। কাজ না হওয়ায় লক্ষ্মীর অনুরোধে বৃন্দাবন লোকলস্কর নিয়ে যান মাসির বাড়ি। গিয়ে দেখেন, তিনটি দরজাই বন্ধ। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাঁরা সারি সারি মালসার খাবার লুঠ করে নেন। পাণ্ডুয়া শশীভূষণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক প্রফুল্লকুমার পান তাঁর ‘গুপ্তিপাড়ায় শ্রী শ্রী বৃন্দাবন জিউর আবির্ভাব ও রথযাত্রা’ বইতে এর পরিচয় দিয়েছেন এ ভাবে — “লন্ডভন্ড হয়ে যায়
ভোগ উপাচার।/ তাতে জগন্নাথে
হয় চেতনা সঞ্চার।।”

এখন সেই মালসাগুলোয় থাকে হরেক রকম মুখরোচক খাবার। গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, পায়েস, মালপোয়া, বেগুন-কুমড়ো ভাজা, পনিরের তরকারি থেকে লাবড়া। থাকে নানা রকম ফল, ক্ষীর-ছানা-মিষ্টি। ওই তল্লাটের বেশ কিছু বাড়িতে সে রাতে, এমনকী, পরদিনও রান্নার পাটই থাকে না। খাবার তৈরি, মালসায় ভরা, তদারকি— সে এক এলাহি ব্যাপার। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে সে সবের প্রস্তুতি। পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রুখতে থাকে পুলিশ পাহারা। গোবিন্দানন্দ পুরি বলেন, “লেখায় পেয়েছি, সেই ১৮৫৮ সালে নাকি এক লক্ষ লোক জড়ো হয়েছিলেন ‘ভাণ্ডারা লুঠ’-এর অনুষ্ঠানে।”

Advertisement

লুঠের আগে রথযাত্রা। ঐতিহ্যপূর্ণ বৃন্দাবন মন্দিরের পাশে বছরভর সেই রথ পেল্লাই টিনের খাঁচায় ভরা থাকে। প্রায় ২৮০ বছরের পুরনো চার তলা এই রথ। উচ্চতা প্রায় ৩৬ ফুট। দৈর্ঘ্য ও প্রস্ত ৩৪ ফুট করে। বৃন্দাবন মন্দির থেকে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা রথে চড়ে যান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গোসাঁইগঞ্জ-বড়বাজারে মাসির, মানে ‘গুণ্ডিচা’ বাড়ি। রথযাত্রা দেখতে প্রচুর লোক সেখানে ভিড় করেন। ইতিহাসের শিক্ষক বিশ্বজ্যোতি হালদার বলেন, ‘‘গুপ্তিপাড়ার রথের ঐতিহ্য এতটাই যে দূর-দূরান্তের লোক আসেন তা দেখতে। ’’ রথে থাকে চারটি দড়ি। প্রতিটি প্রায় ৩০০ ফুট দীর্ঘ। একটি দড়ি কেবল মহিলাদের জন্য। দড়ির আঁশ ঘরে রাখলে মঙ্গল হতে পারে এই বিশ্বাসে রথ টানার সময় অনেকে চেষ্টা করেন আঁশ খুলতে। প্রফুল্লকুমার পান লিখেছেন— “গুপ্তিপাড়া-রথ-কাছি ক্রমে ছোট হয়।/ রথের টান-কালে তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে নেয়।।/ ছেঁড়া-কাছি ঘরে রাখে শান্তির কারণে।/ কত শত মনোবাঞ্চা পূর্ণ হয় মনে।।”

উল্টোরথে বেলা সাড়ে ৫টা নাগাদ একসঙ্গে খোলে মাসির বাড়ির তিনটি দরজা। ভিতরে রাখা থাকে মালসাগুলো। দুপুর থেকেই সেগুলো ‘দখল করার’, নিদেনপক্ষে ভাগ পাওয়ার আশায় সমবেত হয় জনতা। সে দিক থেকে এই রথযাত্রায় আকর্ষণের উপাদান কম নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন