স্থাপত্য পুনর্নির্মাণে আগ্রহী ড্যানিসরা

গঙ্গার পাশে ভগ্নস্তূপের মতো পড়ে দ্বিতল একটি ভবন। বছর বছর ধরে আলো-জল পেয়ে পুষ্ট দেওয়ালের বট-অশ্বত্থ। আর, বার বার সেই বাড়িটাকে চারপাশ থেকে দেখছেন ডেনমার্কের দুই পদস্থ আধিকারিক। সঙ্গে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ও প্রশাসনের কিছু অফিসার ও স্থপতিরা। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল। বাড়িটির পুনর্নির্মাণ হবে ড্যানিশ সরকারের অর্থানুকূল্যে।

Advertisement

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫৬
Share:

সঙ্গের ছবিটি ড্যানিস সরাইখানার।

গঙ্গার পাশে ভগ্নস্তূপের মতো পড়ে দ্বিতল একটি ভবন। বছর বছর ধরে আলো-জল পেয়ে পুষ্ট দেওয়ালের বট-অশ্বত্থ। আর, বার বার সেই বাড়িটাকে চারপাশ থেকে দেখছেন ডেনমার্কের দুই পদস্থ আধিকারিক। সঙ্গে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ও প্রশাসনের কিছু অফিসার ও স্থপতিরা। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল। বাড়িটির পুনর্নির্মাণ হবে ড্যানিশ সরকারের অর্থানুকূল্যে।

Advertisement

১৭৫৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ড্যানিশরা শ্রীরামপুরে থাকতে শুরু করেন। ১৮৪৫ পর্যন্ত সেখানে তাঁদের উপনিবেশ ছিল। স্বদেশের ট্যাভার্নের ধাঁচে শ্রীরামপুরে মিশন ঘাটের কাছে ১৭৮২ সালে ড্যানিশরা তৈরি করে ওই সরাইখানা। বহুকাল পরিত্যক্ত অবস্থায়। কোপেনহাগেন থেকে আসা ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ডেনমার্ক’-এর কিউরেটর বেন্টে ওলফে এ দিন প্রতিবেদককে বলেন, “আমরা এটির পুরনো আদল ফিরিয়ে আনব। পুরনো ছবি আছে। স্থপতিদের সঙ্গে কথা হয়েছে।” কনজার্ভেশন আর্কিটেক্ট মণীশ চক্রবর্তী বলেন, “কী ভাবে আগের আদল অক্ষুণ্ণ রেখে পুনর্নির্মাণ সম্ভব, তা নিয়ে ওঁরা সবিস্তার বলেছেন।”

১৫ হাজার বর্গফুটের উপর জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছিল ওই দ্বিতল সরাইখানা। ঠিক সামনে বিস্তীর্ণ গঙ্গা। পিছনে জেলা পুলিশ লাইন। এ দিন দুপুরে ওখানে গিয়ে দেখা যায়, মূল প্রবেশপথের সামনে ছাউনি দিয়ে একটি চায়ের দোকান। বাড়ির সামনের দিকের দু’টো তলই ধসে গিয়েছে। যে যুবক দোকান চালাচ্ছে, সে বা ২-৩টি খদ্দের, তারা কেউ জানে না বাড়িটি কী ছিল। বাড়ির ডান পাশের ফাঁকা অংশে পরবর্তী কালে এসডিপিও-র অফিস তৈরি হয়েছে। বহুকাল রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচর্যা না হওয়ায় ছাপ।

Advertisement

পুরনো ছবি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ড্যানিস প্রতিনিধিরা। সেই ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন এখনকার অবস্থা। ড্যানিস স্থপতি ফ্লেমিং আলুন্দ চান, পুনর্নির্মিত ট্যাভার্নে বিলিয়ার্ড রুম, পাবেযেন তাঁদের নিজস্বতার আদল থাকে। কত সময় ও খরচ লাগতে পারে? মণীশবাবু বলেন, “শীঘ্র দরপত্র ঘোষণা করার কথা। কয়েক পর্যায়ে এটির সংস্কার ও সংরক্ষণ হবে। প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ হতে পারে।”

ইতিমধ্যে ড্যানিসদের অর্থানুকূল্যে শ্রীরামপুরের ড্যানিস গভর্নর হাউস এবং সেন্ট ওলাভ গির্জার সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। বুধবার ড্যানিস প্রতিনিধিরা নবান্ন-তে গিয়ে দেখা করেন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব অত্রি ভট্টাচার্যর সঙ্গে। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সৌজন্যসাক্ষাৎ করেন। আজ শুক্রবার তাঁর সঙ্গে ওঁরা আলোচনায় বসবেন। কেন প্রশাসনের সাহায্য চাইছেন? বেন্টে বলেন, “কেবল গির্জা ও ট্যাভার্ন নয়, আমরা আশপাশটাও পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করতে চাইছি। তাই প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।” এ ব্যাপারে অত্রিবাবুর কাছে জানতে চাইলে বলেন, “ড্যানিশদের এই আগ্রহে আমরা সত্যিই খুশি। ওঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে। সব রকম সহযোগিতা করব আমরা।”

১৮০০-তে সেন্ট ওলাভ গির্জার নির্মাণ শুরু। লেগেছিল বছর পাঁচ। ১৮ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়েছিল। এ দিন সেখানে দেখা গেল, ভিতরের হলঘরে সংস্কারের কাজ চলছে। তবে সামনে নতুন রঙে ঝকঝক করছে ড্যানিস গভর্নরের ভবন। বাড়িটির একাংশ তৈরি হয়েছে ১৭৮৭ সালে। পিছনের অংশ পরবর্তী কালে তৈরি করে ব্রিটিশরা। এর সংস্কারের দায়িত্বে আছেন স্থপতি গোপা সেন। তিনি বলেন, “এটি সংস্কার করাচ্ছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। ট্যাভার্নের মতো এই ভবন ভেঙে গিয়েছিল। আয়তন ১২ হাজার বর্গফুটেরও বেশি। ২০০৮ থেকে দুই পর্যায়ে সংস্কারের পরে এই অবস্থায় এসেছে। এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৭০ লক্ষ টাকা। তৃতীয় অর্থাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ের জন্য ৯০ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে। এটা পেলে কাজ শেষ হতে এক বছর লাগবে।”

১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর থেকে বিদায় নেয় ড্যানিশরা। ওই শহরের নিয়ন্ত্রণ বর্তায় ব্রিটিশদের হাতে। গির্জা, গভর্নর হাউস, ট্যাভার্ন ক্রমে ব্রাত্য হয়ে ওঠে। রাজপুরুষদের সম্মান জানাতে কামান দাগা হত। পড়ে থাকা সে সব কামান নিয়ে ১৯৪০ সালে গির্জার সামনে তৈরি বাগানে রাখা হয়। ফেন্সিংয়ে দোকানি ও বাস শ্রমিকদের জামা শুকোচ্ছে। বেন্টে বলেন, “আমরা চাই সব সাফসুতরো থাকবে।” শ্রীরামপুরের পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “নয়া বাস টার্মিনাস তৈরি করছে এইচআরবিসি। মাস ছয় শুরু হয়েছে। গির্জার সামনে থেকে বাস টার্মিনাস সরানো হবে।”

পুনর্নির্মিত ভবনগুলোয় কী হবে? বেন্টে এ দিন বলেন, “গির্জার দায়িত্ব ক্যালকাটা ডায়াসেসের উপর। ওটা থাকবে উপাসনার জন্যই। বাকি দু’টো সংগ্রহশালা। রাজ্যের তথ্য সংস্কৃতি দফতর ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে। আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন