সাতসকালে বেরিয়ে যান মা-বাবা দু’জনেই। মাটি কাটা, চা-বাগানে পাতা তোলা, ইটভাটা, মাছের ভেড়ি বা চাষের কাজ করতে। পেট চালাতে অনেকে কারখানা বা লোকের বাড়িতে কাজ করেন। ফেরেন সেই সন্ধে হলে। মাঝের সাত-আট ঘণ্টা তাঁদের অনেকেরই সদ্যোজাত থেকে ৬ বছরের শিশুদের আশ্রয় জোটে ক্রেশে। সেখানে তারা লেখাপড়া শেখে। তিনবেলা খাবার ও চিকিৎসার সুযোগ পায়। মেলে নিরাপত্তাও।
দরিদ্র শিশুদের সেই সুযোগ এখন কেন্দ্র-রাজ্যের তুমুল লড়াইয়ে বিশ বাঁও জলে। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ এবং নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে।
‘রাজীব গাঁধী জাতীয় ক্রেশ প্রকল্প’-এর আওতায় পশ্চিমবঙ্গে এই রকম ৭৭১টি ক্রেশ রয়েছে। প্রতিটিতে ২৫-৩০টি বাচ্চা থাকে। নিয়ম অনুযায়ী একটি ক্রেশে ২৫ জন শিশু থাকতেই হবে। ক্রেশগুলি চালাতে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক টাকা দেয় রাজ্যগুলিকে। গত ৩১ মার্চ রাজ্য সমাজকল্যাণ বোর্ডকে লেখা চিঠিতে কেন্দ্র জানিয়ে দিয়েছে, তারা রাজ্যের ৭৭১টির মধ্যে ৪৮৯টি-ক্রেশের আর্থিক অনুমোদন বাতিল করে দিচ্ছে।
কেন? কেন্দ্র জানিয়েছে, বাতিল হওয়া ক্রেশগুলি তাদের দেওয়া শর্ত পূরণ করতে পারেনি। গোটা রাজ্যে ক্রেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে মোট ৩৯৭টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এর মধ্যে মাত্র ১৫৮টি কেন্দ্রের অনুমোদন পেয়েছে। দিল্লির এই সিদ্ধান্তে গোটা উত্তরবঙ্গ ও বর্ধমান জেলায় কার্যত এমন ক্রেশই আর থাকবে না। ফলে ১৩ হাজারেরও বেশি শিশু সারা দিন কোথায় থাকবে, কোথায় খাবে, তাদের নিরাপত্তার কী হবে— উঠেছে সেই প্রশ্ন।
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ রাজ্য সমাজকল্যাণ বোর্ড। তাদের অভিযোগ, এর পিছনে রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের আক্রোশ কাজ করেছে। চিঠি আসার পরে কেন্দ্র-রাজ্যের সমাজকল্যাণ বোর্ডের কর্তাদের মধ্যে টেলিফোনে বেশ কয়েক বার কথা কাটাকাটি হয়েছে। এখন দু’পক্ষের বিরোধ চরমে উঠেছে। এই নিয়ে হেস্তনেস্ত করতে আগামী সপ্তাহেই দিল্লি যাচ্ছেন রাজ্যের কর্তারা।
রাজ্য সমাজকল্যাণ বোর্ডের প্রধান সুরঞ্জনা চক্রবর্তী জানান, আগে কেন্দ্র ক্রেশ-প্রতি বছরে ৪২ হাজার টাকা দিত। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেই টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে ১ লক্ষ টাকা করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য নতুন নিয়মও। তাঁর দাবি, ‘‘আমরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে দিয়ে কেন্দ্রের সব নিয়ম পূরণ করেছি। তবু গত বছরের মার্চের পর থেকে কেন্দ্র কোনও টাকা পাঠায়নি! নিজেদের টাকা দিয়েই ওই সংস্থাগুলি ক্রেশ চালিয়েছে। অথচ দিল্লি এখন বলছে, অর্ধেকের বেশি এনজিও আর ক্রেশ বাতিল!’’
কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ বোর্ডের যুগ্ম অধিকর্তা এলসিক কেইসিং-এর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘যে সব ক্রেশ আমাদের সব শর্ত পূরণ করতে পারেনি, সব তথ্য সময়ে জমা দিতে পারেনি— তারাই অনুমতি পায়নি। আর গত এক বছরে যে টাকা সংস্থাগুলি খরচ করেছে, তার সব বিল পাঠালে আমরা সে সব বিশ্লেষণ করে টাকা ‘রিইমবার্স’ করে দেব।’’
কিন্তু শিশুদের আশ্রয়ের কী হবে? সেই বিষয়ে কেন্দ্র অবশ্য বল ঠেলে দিয়েছে রাজ্যের কোর্টে।