চিন্তার চর্চায় মানববিদ্যাই মন্ত্র গায়ত্রীর

উচ্চশিক্ষায় হিউম্যানিটিজকে অনেক, অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এক কথায় বলতে গেলে, মানবিকী বিদ্যা না থাকলে দেশের ভবিষ্যৎও শেষ।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:১৭
Share:

প্রেসিডেন্সিতে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। ছবি: সুমন বল্লভ

উচ্চশিক্ষায় হিউম্যানিটিজকে অনেক, অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এক কথায় বলতে গেলে, মানবিকী বিদ্যা না থাকলে দেশের ভবিষ্যৎও শেষ।

Advertisement

প্রেসিডেন্সির দু’শো বছর পূর্তি উপলক্ষে আলোচনাসভায় এ রকমই জোরালো সওয়াল করলেন প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। মার্কিন দেশের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা তিনি, সর্বোচ্চ সম্মান ‘ইউনিভার্সিটি প্রফেসর’ তাঁর পদ। কিন্তু সেটাও তাঁর পরিচয় হিসেবে নেহাত যৎসামান্য। বিরাট মাপের ভাবুক গায়ত্রী। বিশ্বজোড়া উত্তর-ঔপনিবেশিক চর্চার প্রধান ভারতীয় মুখ, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক স্তরে বাঙালি বিদ্বজ্জনদের অগ্রগণ্য।

সেই তিনি বললেন, কেবল হিউম্যানিটিজ বা মানবিকী বিদ্যা শিক্ষার মধ্য দিয়েই নিজের নিজের ভাবনার খোলস থেকে বেরিয়ে অন্যান্য ভাবনাকে অনুমান বা অনুভব করা সম্ভব। আর এই অন্যান্য ভাবনা বা প্রেক্ষিতের সঙ্গে সংযোগ তৈরি না হলে শিক্ষা বিষয়টাই অর্থহীন। সোমবারের শীত সকালে কলকাতার শ্রোতারা গায়ত্রীর অসামান্য বাগ্মিতার সাক্ষী হয়ে রইলেন। পঞ্চাশের দশকে যখন প্রেসিডেন্সির ছাত্রী ছিলেন, তখনই সুবক্তা এবং দুর্ধর্ষ তার্কিক হিসেবে নাম কিনেছিলেন। পঁচাত্তরের চৌকাঠেও সেই ঔজ্জ্বল্য একটুও কমেনি।

Advertisement

অনুষ্ঠানের ‘থিম’, গ্লোবাল হায়ার এডুকেশন বা বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা। তাই হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা-সূত্রেই গায়ত্রী ধরতে চাইলেন ঔপনিবেশিক উচ্চশিক্ষার দোষগুণ, সমস্যা-সম্ভাবনা। বললেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষার মধ্যে অনেক গলদ ছিল। স্বাধীন ভারতে যে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হল, তার মধ্যেও সেই সব গলদ থেকে গেল। এক দিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে একটা বিরাট অংশ হলেন টেকনোক্র্যাট বা প্রযুক্তিবিদ। আর একটা অংশ— ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যুরোক্র্যাট’। এই শ্রেণির পক্ষে সামাজিক ন্যায় বিষয়টা বোঝার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই। ব্যক্তিগত সাফল্য ছাড়া তাঁদের কোনও লক্ষ্য নেই। তাঁদের মধ্যেই জন্ম নিল এক ধরনের বোধহীন জাতীয়তাবাদ। এর ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু যা হল, সেটাকে দেশের উন্নয়ন না বলে অবনয়ন বলাই ভাল। কেবল লাভের দিকে দৃষ্টি রেখে সমাজের দীর্ঘমেয়াদি ভাল-র প্রতি একটা গভীর উদাসীনতা— গায়ত্রীর ভাষায়, ‘সাস্টেনেবল আন্ডারডেভেলপমেন্ট’।

উল্টো দিকে ঔপনিবেশিক ধারার সূত্রেই ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্য ইত্যাদি যে ভাবে এলিট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হল, তাতে কী ঘটল? দেশের মধ্যে কিছু এলিট মানুষের বৃত্ত তৈরি হল, যাঁরা ইংরেজিতে পড়ালেখা করেন, আন্তর্জাতিক গবেষণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ রাখেন। হয়তো পশ্চাৎপদ শ্রেণির কিছু ব্যতিক্রমী ছেলেমেয়ে ক্রমে এই এলিট বৃত্তে জায়গা করে নিল। কিন্তু তারা সেই এলিট-এরই অংশ হল।

সব মিলিয়ে ছবিটা মোটেই উৎসাহ জাগানোর মতো নয়। কিন্তু তবু গায়ত্রীর মতে, আশাটা লিবারেল আর্টস-এই। এই হিউম্যানিটিজই ভাবনার সংকীর্ণতা থেকে শিক্ষাকে বার করে আনতে পারে। নিজের ভাবনাটাকেই শেষ কথা না ভেবে সেটাকে পাশে সরিয়ে রেখে অন্য কল্পনা বা ভাবনার প্রশিক্ষণ দিতে পারে। প্রশ্ন তুলতে পারে: আমি যা জানছি, ভাবছি, বলছি, সেটাই কি চূড়ান্ত? না কি আরও কিছু কথা আছে?

গায়ত্রীর মতে, আজকের ভারতে এই কথাটা আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। বোঝা দরকার, গ্রামেগঞ্জে স্কুলকলেজ তৈরি হলে কী হবে, তাদের ভাবনার খোপ আর এলিটের ভাবনার খোপের মধ্যে আজও সংযোগ নেই। অথচ বিশ্বের সেরা বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকতে থাকতেও গায়ত্রী নিজে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের বসিয়ে পড়ান, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রতি বছর বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানার নাম-না-জানা গ্রামে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তাঁর মুখ থেকে দেশীয় উচ্চশিক্ষা-সমাজের এই ভর্ৎসনা স্বাভাবিক ভাবেই প্রাপ্য। সুবিখ্যাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দু’শো বছরের উৎসবে দাঁড়িয়ে আবেগমথিত দৃঢ়তায় তাঁর তর্জন: এই দেশে কারও সময় নেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষের মন তৈরি করার দিকে। অতি ধীরে, অতি যত্নে, ক্রমাগত আদানপ্রদানে সে কাজ করতে হয়— তাঁর অনবদ্য উদাহরণে, তা ‘স্লো কুকিং’ বা ঢিমে আঁচে রান্নার মতো। কার আছে সেই সময়? বিশেষ করে চতুর্দিকে সবাই যখন ‘ফান্ড রেজিং’-এর তাড়নায় নাজেহাল!

অথচ এই মানুষগুলোই আমাদের দেশের নাগরিক, ভোটের ভোটার, গণতন্ত্রের ‘গণ’। গ্লোবাল হায়ার এডুকেশন বা বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবতে বসে এদের কথাই ভাবতে হবে বই কী। আর একমাত্র মানবিকী বিদ্যার পথেই সেটা সম্ভব, বলে গেলেন গায়ত্রী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন