শাশ্বতী ঘোষ
জন্ম থেকেই হাবরায় আছি। স্কুল, কলেজ, বাজার— সব তো এখানেই। চেনা শহরটা রবিবার যে হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠবে, ভাবতে পারিনি। দুঃখের কথা, সেটা হল আমার দলেরই এক নির্বাচিত জননেতার উস্কানিতে এবং প্রশ্রয়ে। ক্ষমতা জাহির করার জন্য।
আমি সল্টলেকের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ডিরেক্টর। থাকি কেষ্টপুরে। কিন্তু মন পড়ে থাকে হাবরাতেই। ছোটবেলার শহর। গ্রামের মেয়েদের যা হয় আর কী! প্রতি শনিবার হাবরা যাই। রবিবার দিদি-জামাইবাবু আর ওদের পুঁচকেটাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম। দুপুরে ভ্যানরিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছিলাম। সামনে আমি আর দিদি। দিদির কোলে ছেলে। পিছনে বসে জামাইবাবু। হঠাৎ ভ্যানরিকশাটা সজোরে ধাক্কা মারল সামনের একটি গাড়িতে। ছেলেকে নিয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ল দিদি। আমিও পড়ে গেলাম। জামাইবাবু ছিটকে পড়লেন পিছন দিকে।
বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছিল। আমরা ওকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ওর অবস্থা দেখে তখন কারও মাথার ঠিক নেই। জামাইবাবু রেগে গিয়ে ভ্যান-চালককে চেপে ধরল। চালক বললেন, ‘‘সামনের গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক কষায় আমার কিছু করার ছিল না।’’ তখন ওই গাড়ির চালককে ধরা হল। রাস্তার ডান পাশে পেট্রোল পাম্পের সামনে একটা মোটরবাইক দাঁড়িয়ে ছিল। সেটাকে দেখিয়ে গাড়িচালক বললেন, ‘‘হঠাৎ করে ওই মোটরবাইকটা পাম্পে ঢুকতেই আমাকে ব্রেক কষতে হয়েছে। না হলে বাইকে ধাক্কা মারতে হতো।’’
জামাইবাবুর তখন ছুটে গিয়ে বাইক-চালককে ধরল। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম, ওদের মধ্যে চেঁচামেচি হচ্ছে। বাইক-চালক বলছিলেন, ‘‘ইনডিকেটর দিয়েছি।’’ জামাইবাবু বলছিলেন, ‘‘আমার ছেলেটার পড়ে গিয়ে কী হয়েছে দেখে যান।’’ ওই লোকটি দুম করে বলে বসলেন, ‘‘যা হয়েছে আপনাদের হয়েছে। আপনারা সামলান।’’ এর পরেই দু’জনের হাতাহাতি বেধে গেল। তা দেখে কিছু লোক ছুটে এল। ‘‘কার সঙ্গে ঝামেলা করছিস জানিস,’’ বলে ওরা ধাক্কা মারতে লাগল জামাইবাবুকে। তখনও জানি না, কে ওই বাইক-চালক! কাছে গিয়ে শুনি উনি কাউন্সিলর গৌতম বিশ্বাস। জামাইবাবুকে সরিয়ে নিতে ছুটে গেলাম। বাইক-চালককেও বললাম, ‘‘কী করছেন আপনারা? কাউন্সিলর বলে যা ইচ্ছে তাই করবেন?’’
বোধ হয় ওই প্রশ্ন করাটাই আমার অপরাধ হয়েছিল। হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে আমার মুখে ঘুষি পড়ল। যন্ত্রণায় মুখ চেপে ধরলাম। হাতের তালু বেয়ে নাক থেকে রক্ত গড়াচ্ছিল। সে সব দেখেও ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ভয়ে আমি একটু পিছিয়ে যেতেই পিছন থেকে ধাক্কা মেরে আমাকে ফেলে দেওয়া হল মাটিতে। মাথায় বেশ চোট লাগল। তার মধ্যেও আমি চিৎকার করে বলছিলাম, ‘‘এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’ তখন ওই কাউন্সিলর আর ওই লোকগুলো পালায়।
আমার একটাই প্রশ্ন— উনি কাউন্সিলর না হয়ে আমাদের মতো এক জন সাধারণ মানুষ হলে কি দোষ করেও এমন বাড়াবাড়ি করতে পারতেন? এক জন কাউন্সিলরকে যেমন বাড়তি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তেমনই তাঁর দায়িত্ববোধটাও তো বেশি থাকার কথা! মুখ্যমন্ত্রী যখন দলের সবাইকে আরও সংবেদনশীল হতে বলছেন, তখন এক কাউন্সিলর কোনও মহিলার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারেন?
ঘটনাটা মনে করলে এখনও ভয় লাগছে। পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু পুলিশে অভিযোগ জানানোর পর থেকেই আমার পরিবারের লোকজনকে ফোন করে অভিযোগ তুলতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে বলা হচ্ছে। কাউন্সিলর যদি দোষী না হবেন, তা হলে এত ফোন কেন?
আমি কিন্তু এর শেষ দেখেই ছাড়ব।