আইনের ফাঁকে ঢালাও বৈধ হচ্ছে অবৈধ নির্মাণ

ঠিকানা ২০, ডায়মন্ড হারবার রোড। কলকাতা পুরসভার ওয়ার্ড ১১৯। বেআইনি নির্মাণ ৯৭৪০ বর্গফুট। ৭ই নেলী সেনগুপ্ত সরণি। ওয়ার্ড ৬৩। বেআইনি নির্মাণ প্রায় ৩০০০ বর্গফুট।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:৫৮
Share:

ঠিকানা ২০, ডায়মন্ড হারবার রোড। কলকাতা পুরসভার ওয়ার্ড ১১৯। বেআইনি নির্মাণ ৯৭৪০ বর্গফুট।

Advertisement

৭ই নেলী সেনগুপ্ত সরণি। ওয়ার্ড ৬৩। বেআইনি নির্মাণ প্রায় ৩০০০ বর্গফুট।

২২৩ বারাখোলা রোড। ওয়ার্ড ১০৯। বেআইনি নির্মাণ ২৬ হাজার ৩২০ বর্গফুট।

Advertisement

এই তালিকায় রয়েছে এমন আরও ৭০০-রও বেশি বাড়ি, যা পুরসভার নথিতেই বেআইনি হিসেবে উল্লেখ করা রয়েছে। কোনওটার ক্ষেত্রে টাকা নিয়ে আইনি করা হয়েছে। কোনওটা আবার পয়সা না-দিয়েই ছাড় মিলেছে। বিষয়টা নিয়ে বিব্রত পুরসভার অফিসারদের একাংশ। তবে অন্য পক্ষের যুক্তি, বেআইনি নির্মাণ টাকা নিয়ে বৈধ করার আইন তো সরকারই করেছে। সুতরাং ভেবে আর কী হবে?

পুরসভার ওই যুক্তি কতটা বাস্তব এ বার তা দেখতে চায় কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। পুরসভার এক আমলা জানান, সম্প্রতি সিএজি-র রেসিডেন্ট অডিট শাখা বেআইনি নির্মাণকে আইনি করার হিসেব খতিয়ে দেখতে পুরসভাকে চিঠি পাঠিয়েছে। যদিও পুরসভার দাবি, আইন মেনেই এ সব হয়েছে এবং এর জন্য জরিমানা নেওয়া হচ্ছে।

তবে জরিমানা দিয়ে বেআইনি নির্মাণ বৈধ করার বহরে শঙ্কিত নগর পরিকল্পকেরা। পুরসভার প্রাক্তন নগর পরিকল্পক দীপঙ্কর সিনহা বলেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণ বাড়ার সঙ্গে এলাকার সুরক্ষা জড়িত। শহরের সুরক্ষার সঙ্গে আপস করতে যে ভাবে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তা ভয়ঙ্কর!’’

গোটা শহর নিয়ে ‘নাক গলাতে’ চান না প্রাক্তন মেয়র, এখন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তবে দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায় একাধিক বেআইনি নির্মাণ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘১০-১২ বছর ধরেই এ সব চলছে। পুরসভার একাংশ কর্মী-অফিসার এবং পুলিশের যোগসাজশে পেল্লায় পেল্লায় সব অবৈধ বাড়ি হয়েছে। পুরসভা এ সব বন্ধ করতে চাইলে সাহায্য করব। আমার কাছে অফিসার এলে নিজে গিয়ে তাঁদের দেখিয়ে দেব।’’

রাজ্যের ওই প্রবীণ মন্ত্রী যাই বলুন, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সাফ কথা, ‘‘এলাকা, রাস্তা অনেক কিছু দেখে শুনেই কয়েক গুণ চার্জ বেশি নিয়ে তা বৈধ করা হয়েছে।’’ তিনি জানান, যা হয়েছে, সব আইনের শর্ত মেনেই।

কী সেই আইন?

পুরসভার বিল্ডিং দফতর সূত্রের খবর, বেআইনি নির্মাণকে টাকা দিয়ে (পুরসভায় যা রিটেনশন ফি হিসেবে পরিচিত) বৈধ করার রেওয়াজ আগেও ছিল। তবে কোনও আইন ছিল না। পুরসভার প্রস্তাবক্রমে ২০১৫ সালের জুন মাসে রাজ্য সরকার বিধানসভায় বিল্ডিং আইনের ৪০০ ধারায় যে সংশোধন এনেছে, তাতে বলা হয়েছে— ‘মাইনর ডিভিয়েশন’ জরিমানা দিয়ে বৈধ করা যাবে। তবে ‘মাইনর ডিভিয়েশন’ বলতে কী বোঝায়, তা স্পষ্ট করা উল্লেখ করা নেই।

প্রশ্ন উঠেছে— বেহালায় ৯৭৪০ বর্গফুট, বাইপাসের ধারে ২৬ হাজার বর্গফুট, দেশপ্রাণ শাসমল রোডে ১৬০০ বর্গফুট বা মেয়রের ওয়ার্ডে ১২৪, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জ্জি রোডের ঠিকানায় প্রায় ২০০০ বর্গফুট বেআইনি নির্মাণ কী ভাবে ‘মাইনর’ হতে পারে? পুরসভার এক আমলার কথায়, ‘‘আইনে এই ‘মাইনর’-এর ব্যাখ্যা দেওয়া নেই।’’ কেন নেই জানতে চাইলে ওই আমলার বক্তব্য, ‘‘বিধানসভার কাছে যে প্রস্তাব গিয়েছিল, হয়তো হিসেব কষেই মাইনর ডিভিয়েশনের ব্যাখ্যায় ফাঁক রাখা হয়েছিল।’’ আর সেই ফাঁকেই এখন সব ‘গলে’ যাচ্ছে বলে তাঁর অভিমত।

রিটেনশন ফি-র পরিমাণ কেমন?

সিএজি-র কাছে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে পুরসভা, তাতেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ১২৪, ইউ এন ব্যানার্জ্জি রোড ঠিকানার ২০০০ বর্গফুট বেআইনি নির্মাণ বৈধ করার জন্য রিটেনশন ফি বাবদ তারা ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮৫ টাকা নিয়েছে। এক পুর ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ওই এলাকায় বর্গফুট পিছু বাজার দর প্রায় ৪৫০০ টাকা। সেই হিসেবে ২০০০ বর্গফুটের দাম হয় প্রায় ৮০-৯০ লক্ষ টাকা।

কিন্তু ওই রিপোর্টেই আবার দেখা যাচ্ছে, কাঁকুলিয়া রোডের একটি বাড়ির প্রায় ১৪০০ বর্গফুট বেআইনি নির্মাণ বৈধ হয়েছে রিটেনশন ফি ছাড়াই। কেন, তার ব্যাখ্যা অবশ্য দেয়নি বিল্ডিং দফতর। তবে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে, নীতি নির্ধারকদের নির্দেশ মতোই কাজ হয়েছে।

বিল্ডিং দফতর সূত্রের খবর, বেআইনি নির্মাণের খবর পৌঁছলেই পুর আইনের ৪০০ ধারায় নোটিস ধরানো হয়। বেআইনি নির্মাণের জন্য কেন তা ভাঙা হবে না, তার কারণ দর্শাতে নির্মাতাকে পুরসভায় ডাকা হয়। সেখানেই জরিমানার পরিমাণ শোনানো হয়। কেউ রাজি না-হলে বাড়ি ভেঙে ফেলার নির্দেশও দেওয়া হয়। অভিযোগ, জরিমানায় দরাদরি নিয়ে পছন্দ-অপছন্দের কারবার চলে। কাউকে জরিমানা দিতে হয়, কেউ বা এমনিই ছাড় পেয়ে যান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন