আপাতত তিনি দক্ষিণ কলকাতায় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। শুক্রবার আলিপুর থানায় তাণ্ডবের পরে সেই প্রতাপ সাহার কতটা পদোন্নতি হবে, তা নিয়ে এখন জল্পনা দলেই।
যা শুনে কলকাতা পুলিশের এক সহকারী কমিশনারের মন্তব্য, “এই ধরনের ঘটনায় যার নাম জড়ায়, তৃণমূলে তো সাধারণত তার পদোন্নতিই হয়!” যেমন?
যেমন, ২০০৮-এর অক্টোবরে দক্ষিণ কলকাতার একটি থানায় ঢুকে তাণ্ডব ও পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা। সেই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন এক তৃণমূল বিধায়কের ভাই। সেই ঘটনায় কিছু দিনের মধ্যেই গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। এবং পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কারণ, পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়ায় দলের খাতায় অনেকটাই বেড়ে গেল তাঁর নম্বর! বস্তুত, এর কিছু দিন পরেই দক্ষিণ কলকাতায় যুব তৃণমূলের বড় পদে বসানো হয় তাঁকে। এখন তো তিনি দলের একটি সংগঠনের মাথায়! নোদাখালি থানায় রীতিমতো হামলা চালিয়ে ওসি-কে অশ্রাব্য গালিগালাজ এবং নিগ্রহ করা তৃণমূল নেত্রীকে তো সাংবিধানিক পদও দেওয়া হয়েছে!
পুলিশ পিটিয়ে নেতা হওয়ার ট্র্যাডিশন তৃণমূলে যেন মজ্জাগত! শাসক দলের পঞ্চায়েতের কোনও কোনও পদাধিকারী, বিধায়ক এমনকী মন্ত্রীর নামেও একাধিক ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। তৃণমূলের এ হেন পদাধিকারীদের কেউ প্রকাশ্যে পুলিশকে বোম মারার নির্দেশ দিচ্ছেন, কেউ জনসভায় বিরোধী দলের তিন জনকে পায়ের তল দিয়ে পিষে মারার বড়াই করছেন, কেউ বা হুমকি দিচ্ছেন দলের ছেলে ঢুকিয়ে বিরোধীদের মা-মেয়েদের রেপ করিয়ে দেওয়ার!
সরকারি লোকজনের উপরে হামলার ঘটনাতেও পিছিয়ে নেই তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা। কেউ ভোট চলাকালীন বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারের উপরে চড়াও হচ্ছেন তো কেউ আবার ভোটের ঠিক আগে নিগ্রহ করছেন বিডিও-কে!
আর রণংদেহী মূর্তি দেখিয়েই যখন নেতা হওয়া যাচ্ছে, তখন পরের ধাপের নেতা-পদপ্রার্থীরাও হাঁটছেন সেই রাস্তায়। ক্রমেই হয়ে উঠছেন বেপরোয়া। যার জেরেই আলিপুর থানা আক্রমণের মতো ঘটনা। পুলিশ অসহায় দর্শক। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “যারা থানায় ঢুকে হামলা চালাচ্ছে, তারাও নেতা। আর এই আমলে নেতাদের আক্রমণের জবাব দিলে পুলিশের চাকরি রাখাই দায় হবে!”
সেই কারণেই দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক রাজেশ সাউয়ের বিরুদ্ধে ওয়াটগঞ্জ থানার পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। গত জুন মাসে রাজেশের বিরুদ্ধে পাঁচ লক্ষ টাকা তোলা চেয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ জানিয়েছিলেন এক প্রোমোটার। বাড়ি সারাইয়ের কাজে হাত দেওয়া এক গৃহস্থের কাছ থেকেও রাজেশ দেড় লক্ষ টাকা চেয়েছিল বলে অভিযোগ। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ কিছুই করেনি। শেষ পর্যন্ত হুমকি পাওয়া প্রোমোটার লালবাজারে অপরাধ দমন শাখার যুগ্ম কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পরে তারা নড়েচড়ে বসে।
কোন খুঁটির জোরে রাজেশের এই দাপট? স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাজেশ একটা সময়ে ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া নিজামউদ্দিন শামসের ঘনিষ্ঠ ছিল। এখন সে সঞ্জয় বক্সীর ‘লোক’। (যে সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে ২০০১-এর একটি খুনের ঘটনা-সহ বিভিন্ন অপরাধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে।) খিদিরপুরে জমি দখল করে তৃণমূলের পার্টি অফিস তৈরির তোড়জোড় করেও দলে নাম কিনেছে রাজেশ।
পুলিশ প্রশাসন থেকে বিরোধী দল, সকলেরই অভিযোগ, রাজেশের মতো লোকেদেরই এখন রমরমা তৃণমূলে। কলকাতা পুলিশের এক যুগ্ম কমিশনারের কথায়, “রাজনৈতিক দল গুণ্ডা পুষবে, কিছু নেতা মাসল্ম্যান রাখবেন, এটা চিরাচরিত প্রথা। সেই কংগ্রেস আমল থেকে চলে আসছে। কিন্তু এখন নেতা আর গুণ্ডার মধ্যে ‘গ্যাপটা’ ক্রমশ কমে আসছে।”
কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে অশোক সেন, অজিত পাঁজা, প্রফুল্লকান্তি (শত) ঘোষ, সোমেন মিত্রদের বিরুদ্ধে গুন্ডা পোষার অভিযোগ জানাতেন বামেরা। কংগ্রেসিরা আবার পাল্টা অভিযোগের আঙুল তুলতেন সুভাষ চক্রবর্তী, শচীন সেন, রবীন দেবদের দিকে। কিন্তু দুষ্কৃতীদের নেতৃত্বের প্রথম ধাপে উঠে আসার সংস্কৃতি এ রাজ্যে তেমন ছিল না। দু’একটা হাতে গোনা ব্যতিক্রম বাদ দিলে তারা মূলত নেপথ্যেই থাকত।
আর এখন?
কলকাতা পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও এবং ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না দু’জনেই দু’টি খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত। ২০১৩-র এপ্রিলে গ্রেফতার হওয়া শম্ভুনাথ এখনও জেলে। কিন্তু কলকাতা পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টরকে গুলি করে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত মুন্না ২০১৩-র মার্চে গ্রেফতার হলেও এখন জামিনে মুক্ত। কারণ তিনি পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। লালবাজার সূত্রের খবর, মুন্নার বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করার জেরে ববির সঙ্গে বাদানুবাদে জড়ান তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দা। তার জেরে পদও খোয়াতে হয় তাঁকে! ওই যুগ্ম কমিশনারের কথায়, “মুন্নার শাগরেদকেও তো নেতা বলেই গণ্য করতে হবে। বড় নেতা যদি খুনের আসামি হয়, তা হলে ছোট নেতা আর কত ভাল হবে?”
বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, “সিপিএম যে দুর্বৃত্তদের ভোট লুঠের জন্য ব্যবহার করত, তাদেরই তৃণমূল সাংগঠনিক পদ দিয়েছে কিংবা যাতে তারা জনপ্রতিনিধি হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করেছে। এরই ফল আলিপুর থানার ঘটনা।”
পুলিশের একটা বড় অংশের মতে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বাম আমলেই পুরোদস্তুর হয়ে গিয়েছিল। নানুর, আরামবাগ-খানাকুল, গোঘাট, নন্দীগ্রাম, লালগড়ে সিপিএমের ‘হার্মাদ বাহিনীর’ দৌরাত্ম্যের অভিযোগ বহু বার উঠেছে। এক বর্ষীয়ান পুলিশ অফিসার বলেন, “সিপিএমের মদতে পুষ্ট সমাজবিরোধীরা খুন-জখম-লুঠতরাজ কম করেনি। শেষ দিকে তো প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি হয়েছিল।” উত্তর ২৪ পরগনার শাসনের মজিদ মাস্টার, পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার তপন ঘোষ-শুকুর আলির দিকে তখন বারবার অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। এমনকী পরে কঙ্কাল কাণ্ডে অভিযুক্তও হয়েছেন সুশান্ত ঘোষের মতো প্রাক্তন মন্ত্রী। তবে সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়ায় তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের আকাশ-পাতাল তফাৎ বলেই দাবি সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের। তাঁর বক্তব্য, “অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি কমবেশি দুর্বৃত্তদের পোষে। সে জন্যই রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন শব্দবন্ধের উৎপত্তি। কিন্তু তৃণমূল হল দুর্বৃত্তদেরই দল, যারা লোক দেখাতে কিছু ভাল মানুষকে পুষেছে।” তৃণমূলকে ‘আগাপাশতলা সমাজবিরোধীদের দল’ বলে তোপ দেগেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও।
তৃণমূলই যে এমন আক্রমণের পথ করে দিচ্ছে, একান্ত আলোচনায় সে কথা কবুল করছেন দলেরই একাধিক নেতা। তাঁরাই জানাচ্ছেন, মধ্য কলকাতায়, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের যুব তৃণমূলের শীর্ষনেতা সুনীল সাউ ওরফে ঘ্যাঁচার বিরুদ্ধে খুন-সহ অসংখ্য ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। আবার ঘ্যাঁচার সঙ্গে দলের অন্দরে যাঁর সব চেয়ে বেশি দ্বন্দ্ব বলে পুলিশের দাবি, সেই সজল ঘোষ ওরফে দেবু ৫০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের শীর্ষনেতা হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর বিরুদ্ধেও বহু অভিযোগ রয়েছে পুলিশের খাতায়। লাগোয়া ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের যুব তৃণমূল নেতা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে কানকাটা দেবুর বিরুদ্ধে তোলাবাজির বহু অভিযোগ রয়েছে বলে পুলিশের একাংশের দাবি।
ওই মধ্য কলকাতাতেই তৃণমূল সেবাদলের এক পদাধিকারীর বিরুদ্ধে শিয়ালদহ তল্লাটে অন্তত চার-চারটি খুনের অভিযোগ রয়েছে। ২০০৬-এর ডিসেম্বরে তাঁর বিরুদ্ধে নাইন এমএম পিস্তল থেকে গুলি করে এক জনকে খুন করার অভিযোগ ওঠে। তখন তিনি বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, “আমি যতগুলো কাজ করেছি, সবই ওয়ান শটার দিয়ে। আমার একটা দানাই যথেষ্ট। ও সব নাইন এমএম-টেমএমের দরকার হয় না”
এই ধরনের লোকজনই সম্ভবত পছন্দ শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের। তাই দ্রুত দলের প্রথম সারিতে উঠে এসেছেন তাঁরা। আর মহাজনদের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন নেতৃত্বের পরের পরের ধাপ। যা দেখে একদা ‘দুষ্টু ছেলেদের নেতা’ বলে পরিচিত, এই সে দিন পর্যন্ত তৃণমূলে থাকা সোমেন মিত্রের মন্তব্য, “আমার দুষ্টু ছেলেরাও এদের কাজকর্ম দেখে লজ্জা পাচ্ছে!”
তবে আলিপুর থানায় হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে আনন্দবাজারের কাছে কোনও মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন ববি হাকিম। তাঁর কথায়, “এলাকার মানুষ আমাকে ১৫ বছর ধরে চেনেন। তাঁরা জানেন আমি কেমন লোক।”
আর দলের মুখপাত্র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিধিসম্মত সতর্কীকরণ, “কেউ দোষী হলে আইন যা বলবে তা-ই হবে। কিন্তু তার আগে তো দোষ প্রমাণ করতে হবে।”