Nirendranath Chakraborty

ছিল টিনটিন আর কিকিরা-গোগোল, আমার আনন্দমেলা আর সেই সম্পাদক

আনন্দমেলাতেই পেয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু-সন্তু সিরিজ, শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ, বিমল করের কিকিরা সিরিজ, সমরেশ বসুর গোগোল, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের রুকু-সুকু।

Advertisement

ইন্দ্রনীল সান্যাল

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৪৬
Share:

আনন্দমেলায় প্রকাশিত টিনটিন সিরিজ। ইনসেটে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

প্রথম আনন্দমেলা কোথায় দেখেছিলাম আমার স্পষ্ট মনে আছে। ইশকুলে, আমার থেকে এক বছরের ছোট বন্ধুর কাছে। তখন আনন্দমেলায় ‘সোনালি দাঁড়ার কাঁকড়া’ প্রকাশিত হচ্ছে। যেটি আদতে ‘দ্য ক্র্যাব উইথ দ্য গোল্ডেন ক্লজ’-এর বঙ্গানুবাদ। আমার ইংরিজিটা আগেই পড়া ছিল।

Advertisement

কাজেই আর পাঁচজন বাঙালি কিশোরের মতো আমার সঙ্গে আনন্দমেলার পরিচয় টিনটিনের হাত ধরে নয়। সে পাট আমি আগেই চুকিয়ে ফেলেছি। আমি মোহিত হয়েছিলাম পত্রিকাটি দেখে। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম। সেই যে আমাদের বাড়িতে আনন্দমেলা ঢুকল, আজও তার জয়যাত্রা শেষ হয়নি।

আমি ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছি সেই আনন্দমেলা, যা প্রথম দিকে বছরে একটি করে প্রকাশিত হত। যাতে বেরিয়েছিল কাকাবাবু আর সন্তুর প্রথম অ্যাডভেঞ্চার, ‘ভয়ংকর সুন্দর’।সঙ্গে ছিল, যদি খুব ভুল না করি, বিমল দাশের অসাধারণ অলঙ্করণ। ক’জন আমার বয়সী ছেলের সেই সব বার্ষিক সংখ্যা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমি জানি না।

Advertisement

আরও পড়ুন: ‘ভাষা চর্চায় নীরেনদার অবদান বাঙালির পক্ষে ভোলা সম্ভব হবে না’​

ওই বয়সে পত্রিকার ক্ষেত্রে সম্পাদকের কী ভূমিকা, সেটা একজন খুদে পাঠকের জানার কথা নয়। কিন্তু আমি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নাম জানতাম, তার কারণ, আমাদের বাড়িতে একদল বই ও পত্রিকা পাগল মানুষের আনাগোনা ছিল। তাঁদের মুখেই এই ঢ্যাঙা কবির নাম শুনেছিলাম।

পরবর্তীকালে আনন্দমেলা আকারে অর্ধেক হয়ে গেল। সেই পত্রিকার ডামি কপিও দেখেছি, যেটি সবার দেখার জন্যে নয়। ছোট আনন্দমেলা দেখে বেজায় দুঃখ হয়েছিল, কিন্তু সেটা কেটে গেল পত্রিকার তৃতীয় পাতায়, সূচিপত্রের পাশে সম্পাদকের লেখা ছড়া এবং তার সঙ্গে বিমল দাশের ইলাস্ট্রেশন দেখে। এত দশক পার করেও সেই সব ছড়া দিব্যি মনে আছে।

“কী শীত কী শীত দাদা/ কী শীত কী শীত।/ দিবস যদি বা কাটে/ কাটে না নিশীথ।/ নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁথা কম্বলে,/উঁকি মেরে দেখি যায়/ বছরটা চলে।”

আরও পড়ুন: রোদ্দুর হয়ে গেলেন অমলকান্তির কবি নীরেন্দ্রনাথ

নীরেনবাবু ছিলেন বলেই অনেক ‘বড়দের লেখক’ ছোটদের জন্যে কলম ধরেছিলেন। আনন্দমেলাতেই গোগ্রাসে গিলেছি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এর ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’, সঙ্গে সুধীর মৈত্রর অলংকরণ। কিছুদিন আগে সিনেমাটি দেখতে গিয়ে ওই অলংকরণগুলিকে অ্যানিমেশানে রূপান্তরিত হতে দেখে খুব মজা লাগল।

আনন্দমেলাতেই পেয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু-সন্তু সিরিজ, শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ, বিমল করের কিকিরা সিরিজ, সমরেশ বসুর গোগোল, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের রুকু-সুকু। এবং পুজো সংখ্যায় সত্যজিত রায়ের প্রফেসর শঙ্কু। আমাদের শৈশবে হ্যারি পটার ছিল না, আনন্দমেলা ছিল। জে কে রাওলিং ছিলেন না, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন।

ফিরে আসি টিনটিনের প্রসঙ্গে। আমি বাংলা আর ইংরিজি দুটি ভাষাতেই টিনটিন পড়েছি। দুটি ভাষার আলাদা মজা। ইংরিজিতে যে স্নোয়ি, বাংলাতে সে কুট্টুস। ইংরিজিতে যারা ‘thompsonঅ্যান্ড thomson’ বাংলায় তারা জনসন ও রনসন। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের গালাগালি ‘বিলিয়ন্স অ্যান্ড বিলিয়ন্স অফ ব্লু ব্লিস্টারিং বারবিকিউড বার্নাকলস’পড়ে যেমন হেসেছি, তেমনই বাংলায় ‘এক্টোপ্লাজম, হিপোপটেমাস’পড়ে মজা পেয়েছি।

আরও পড়ুন: ‘সিগারেট-চা দিয়ে বসিয়ে আমাকে তালাবন্ধ করে চলে গিয়েছিলেন’​

টিনটিনের আমি এমনই ফ্যান ছিলাম যে বন্ধুর কাছ থেকে অ্যার্জের ঠিকানা জোগাড় করে ওঁকে চিঠি লিখেছিলাম। এবং খুব আশ্চর্যের বিষয় হল যে উনি উত্তর দিয়েছিলেন। লাল-নীল বর্ডারওয়ালা সেই খাম, সেই চিঠি, সেই সাক্ষর করা ফোটোগ্রাফ আমার কাছে আজও রাখা আছে। যেমন রাখা আছে বাঁধাই করা পুরনো আনন্দমেলা আর পুজো সংখ্যা আনন্দমেলা।

আমার সেই মফস্‌সলি শৈশব আজকের এই ডিজিটাল দুনিয়ায় দেরাজে তুলে রাখা মরচে পড়া তোরঙ্গের মত বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু কখনও কখনও এমন সময় আসে, যখন সেই তোরঙ্গ খুলতে হয়। তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে শৈলেন ঘোষের বাগডুম সিং, ক্যালকুলাসের পেন্ডুলাম দুলিয়ে ‘পশ্চিমে আরও পশ্চিমে’স্বগতোক্তি, কুন্তকের ‘শব্দ নিয়ে খেলা’, ‘কী বলছে ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয়’... আর তাঁদের সঙ্গে যিনি আলাপ করয়েছিলেন সেই ঢ্যাঙা মানুষটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন