রাজ্য বাজেট

ঘাটতির বহরে প্রকট বাংলায় শিল্পের দুর্গতি

আর্থিক সমীক্ষা যে দিন দেশের বৃদ্ধির হার ৮% ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাল, সে দিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তিন লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আগামী অর্থবর্ষের (২০১৫- ১৬) বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। শুক্রবারের সেই বাজেট এ-ও দেখিয়ে দিল, শেষ হতে চলা অর্থবর্ষে এ রাজ্যে রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৬
Share:

বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। শুনছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। শুক্রবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।

আর্থিক সমীক্ষা যে দিন দেশের বৃদ্ধির হার ৮% ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাল, সে দিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তিন লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আগামী অর্থবর্ষের (২০১৫- ১৬) বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। শুক্রবারের সেই বাজেট এ-ও দেখিয়ে দিল, শেষ হতে চলা অর্থবর্ষে এ রাজ্যে রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায়।

Advertisement

গত বছর (২০১৪-১৫) বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী এই রাজস্ব ঘাটতি নির্মূল করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এক দিকে মেলা-খেলা-মোচ্ছবে রাশ না পড়া, অন্য দিকে রাজস্ববৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অধরা থেকে যাওয়ায় অমিতবাবু রাজ্যবাসীর ঘাড়ে বিরাট অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতিই চাপিয়ে দিয়েছেন। যা কিনা আসলে ঘুরে-ফিরে রাজ্যের শিল্পায়নের সেই করুণ ছবিটাকেই তুলে ধরছে বলে অর্থ-কর্তাদের অনেকের অভিমত। তাঁরা এ-ও বলছেন, শিল্প না-এলে রাজ্যে কর আদায়ের পরিমাণ যে বাড়বে না, রাজস্ব ঘাটতির পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট।

অন্য দিকে এ দিনই বিধানসভায় পেশ করা রাজ্যের আর্থিক সমীক্ষায় প্রকাশ, বাস্তবায়িত হচ্ছে এমন লগ্নির পরিমাণ গত বছরের তুলনায় এ বার অনেকটা কমেছে। পাল্লা দিয়ে কমেছে শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থানও। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লগ্নি প্রস্তাবের কথা বলা হলেও রাজ্যের বাস্তব ছবিটা যে অন্য, তা ধরা পড়েছে আর্থিক সমীক্ষাতেই। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ সালে ১৫০টি প্রকল্পে ১৭ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা লগ্নি হয়েছে অথবা রূপায়ণের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবষের্র্ সেটাই কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকায়। ১৪৮টি প্রকল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার মানুষের। যেখানে গত বছরের দাবি অনুযায়ী শিল্পে কর্মসংস্থানের অঙ্ক ছিল ১ লক্ষ ৩০ হাজার।

Advertisement

শিল্পের এ হেন হাল অস্বস্তি ছড়িয়েছে সরকারের অন্দরমহলেও। রাজ্যের এক মন্ত্রী এ দিন বলেন, “যে বছর মুখ্যমন্ত্রী বিনিয়োগ টানতে সিঙ্গাপুর গেলেন, বেঙ্গল গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট করলেন, সে বছরেই লগ্নি ৭ হাজার কোটি টাকা কমে গেল! আর ১ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে শিল্পে কর্মসংস্থানের সংখ্যা দাঁড়াল মাত্র ৩০ হাজারে।” তাঁর আরও মন্তব্য, “লগ্নির পরিসংখ্যান দিতে গিয়ে গত এক বছরে ঠিক কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তার পরিমাণ আলাদা করে অর্থমন্ত্রী জানাননি। কাজ সবে শুরু হয়েছে, এমন প্রকল্পও এর মধ্যে ধরা হয়েছে!” এক বছরে প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রকাশ পেলে পরিস্থিতি আরও লজ্জাজনক হতো বলেই মনে করছেন ওই মন্ত্রী। শিক্ষা, পঞ্চায়েত, পূর্ত বা জনস্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যয়বরাদ্দ না-হওয়ায় তৃণমূলের ভিতরেই অনেকে হতাশ। কেউ কেউ ক্ষোভ গোপনও রাখেননি।


কাজের ফাঁকেই সৃষ্টি। বিধানসভায় নিজের ঘরে বসে ফোনে কথা বলতে বলতেই ছবি
আঁকছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুগ্ধ দর্শক অর্থমন্ত্রী। শুক্রবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।

রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তও শিল্প-বন্ধ্যাত্বের প্রসঙ্গ তুলে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর কৈফিয়ত দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, “রাজস্ববৃদ্ধির হার কমার কারণ, রাজ্যে শিল্প হয়নি।” প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর দাবি, “কোন জেলায় ক’টি শিল্পে কত বিনিয়োগ হয়েছে, অর্থমন্ত্রী তার তালিকা প্রকাশ করুন।”

পাশাপাশি বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ‘বায়বীয় লগ্নি’র কথা বলে সরকারকে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “গত বৃহস্পতিবার সরকার বিধানসভায় দাবি করেছিল, ২ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। অথচ বাজেট-বক্তৃতায় ২ লক্ষ ৪১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলা হল। মানে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ৪১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ লাফিয়ে বেড়ে গেল!” সূর্যবাবুর পর্যবেক্ষণ, “আসলে রাজ্যে শিল্প নেই। এ সবই শূন্যে আস্ফালন!” বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “নব্বই পাতার বাজেটে নয়া পয়সার শিল্পেরও উল্লেখ নেই। না এলে শিল্প, দাঁড়াবে না গল্প! ধারের বাজেটে ভার বাড়ছে মানুষের।”

বস্তুত শিল্পায়নের দুর্গতির জন্যই যে রাজস্ববৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো যাচ্ছে না, অর্থ দফতরের কর্তারা তা কবুল করছেন। বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে আর্থিক নীতি সংক্রান্ত পর্যালোচনায় অর্থ দফতর মেনে নিয়েছে যে, রাজস্ববৃদ্ধির হার থমকে গিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘২০০৯-১০ অর্থবর্ষে নিজস্ব কর সংগ্রহের বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ১৭.২১%, ২০১২-১৩য় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৫৬%-য়। কিন্তু পরের বছরই তা নেমে এসেছিল ৯.২১%-এ। এখন আবার বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।” অথর্মন্ত্রী অমিতবাবু অবশ্য বাজেট পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে আশ্বাস দিয়েছেন, “এই হার কখনও কখনও থমকে যায়। দম নেওয়ার জন্য এটুকু সময় দরকার হয়। কর সংগ্রহ আবার আগের মতোই বাড়বে।”

যদিও অর্থমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে অর্থ-কর্তাদের অনেকে একমত নন। তাঁরা জানাচ্ছেন, তিন বছর আগে কর আদায় এক ধাক্কায় ২৫ হাজার কোটি থেকে ৩৩ হাজার কোটিতে তোলা সম্ভব হয়েছিল, কারণ সে বার ভ্যাটের হার ১% বাড়ানো হয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধি ও তেলের দাম বাড়ার ফলে রাজ্যের ঘরে মোটা টাকা এসেছিল। কিন্তু এই সরকার আসার পরে শিল্প-বাণিজ্যের বহর তেমন বাড়েনি। তাই ক্রমশ কর আদায়েও ভাটার টান। এই মহলের দাবি, গুজরাত, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে শিল্প-বাণিজ্যের বহর বেশি হওয়ায় তাদের নিজস্ব কর সংগ্রহের অঙ্ক পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি। পাশাপাশি ওই সব রাজ্যে নিত্যনতুন শিল্প গড়ে উঠছে বলে কর্পোরেট ট্যাক্স ও আয়কর আদায় অনেক বেশি হয়। পরিণামে কেন্দ্রীয় সরকার অনেক বেশি টাকা তাদের ফিরিয়ে দিতে পারে, যার দৌলতে উন্নয়নের কাজে বেশি জোর দেওয়া যায়।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে?

অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, এখানে শিল্প নেই, বড় ব্যবসা নেই, পরিকাঠামোয় বড় বিনিয়োগ নেই। স্বাভাবিক ভাবেই কর আদায়ের উপরে এর প্রভাব পড়বে। সরকারকে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাই করতেই হবে।

অমিতবাবুর বাজেটে কার্যত তারই প্রতিফলন। গত বার রাজ্যের ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের বাজেট প্রস্তাব পেশ করে তিনি রাস্তা-সেতু-বিদ্যুৎকেন্দ্র-হাসপাতাল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ‘সম্পদ সৃষ্টি’ (ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার) খাতে ২৪ হাজার ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। বছর শেষে তা কমিয়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি করতে হয়েছে।

বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান হিসেবে গত বছর ৩০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও মিলেছে ২৬ হাজার কোটি। অর্থ কর্তারা জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকা রাজ্য জোগাড় করতে না-পারায় দিল্লির টাকা পাওয়ার সুযোগ হারাতে হয়েছে। তাঁদের যুক্তি, শিল্প থাকলে, বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাড়লে মোটা টাকা ভ্যাট আদায় হতো। যা দিয়ে উন্নয়নের কাজ আরও ভাল ভাবে করা যেত।

শিল্প-চিত্রের করুণ দশার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থ দফতরের এক শীর্ষ আমলা এ দিন জানিয়েছেন, রাজ্যে আর্থিক কর্মকাণ্ড যে সে ভাবে বাড়েনি, তার অন্যতম প্রমাণ, সরকার স্ট্যাম্প ডিউটি খাতেও আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারেনি। “যে রাজ্যে প্রোমোটারিই একমাত্র শিল্প, সেখানে এই আদায় কম হওয়াটা দুরবস্থার নামান্তর! সে কারণেই বাড়ি বা ফ্ল্যাটের বিক্রি বাড়াতে রেজিস্ট্রেশনে স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড় দেওয়ার কথা ভাবতে হয়েছে সরকারকে। ৩০ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে এ বার ৪০ লক্ষ টাকা অবধি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশনে স্ট্যাম্প ডিউটিতে এক শতাংশ ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছে সরকার, যার সুবিধা পাবেন মধ্যবিত্ত ক্রেতারাই। ফলে একদিকে তাঁরা যেমন খুশি হবেন, তেমনই ফ্ল্যাট বিক্রি বাড়লে রাজ্যের আবাসন শিল্পেরও কিছুটা উন্নতি হবে।” মন্তব্য তাঁর। একই সঙ্গে অর্থ দফতরের একাধিক কর্তাই বলছেন, মানুষের পকেটে টাকা নেই, তাই মদ বেচে যত টাকা তোলার কথা ভাবা হয়েছিল, তা ওঠেনি। গাড়ির কর বাবদ যে টাকা আদায় হবে বলে ভাবা হয়েছিল, তা-ও এখনও পর্যন্ত অধরা রয়ে গিয়েছে।

তা হলে মেলা-খেলা-খয়রাতি বা সুযোগ-সুবিধা বিলির জন্য সরকারি টাকার জোগাড় হবে কোথা থেকে?

তার জন্য বাজেটে বাজার থেকে নেওয়া ঋণ ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া অগ্রিমের উপরেই ভরসা রাখা হয়েছে। এ বারও খরচ চালাতে বাজার থেকে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। গত অর্থবর্ষে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে অগ্রিম ও ওভারড্রাফ্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল। এ বার অঙ্কটা আরও বাড়বে বলেই জানাচ্ছেন অর্থ-দফতরের কর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন