স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারাবাহিক অশান্তির নজির ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে এই আমলে। এ বার তা ছড়িয়ে পড়ছে শিল্পের চত্বরেও। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন জেলায় একাধিক শিল্প-সংস্থায় অশান্তি ছড়িয়েছে, এমনকী কারখানার গেটে তালাও ঝুলেছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ শনিবার এক দিনে হলদিয়ায় একটি ভোজ্য তেল কারখানা, রানিগঞ্জে জে কে নগর কোলিয়ারি এবং হাওড়ার বার্ন স্ট্যান্ডার্ড।
বেতন বৃদ্ধি ও বকেয়া মেটানোর দাবিতে অস্থায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভের জেরে শনিবার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা উৎপাদন ব্যাহত হল হলদিয়ায় রুচি সয়া ইন্ডাস্ট্রিজের ভোজ্য তেল কারখানায়। কারখানাটিতে প্রায় ১২০০ অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন। তার মধ্যে ৩৫০ জন এ দিন সকাল থেকে কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভে সামিল হন। এঁরা সকলেই শাসক দল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-এর সমর্থক। সমস্যা সমাধানে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। তার পর ফের শুরু হয় উৎপাদন।
সংস্থার সিনিয়র ম্যানেজার (এইচআর) নরোত্তম শুক্ল বলেন, “কিছু শ্রমিক দাবিদাওয়া নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। তাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।” টিফিনের কিছু ক্ষণ পর পর্যন্ত ওই অস্থায়ী শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ রেখেছিলেন এ কথা মেনে নিয়ে আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি তুষার মণ্ডল বলেন, “অস্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা-গণ্ডা অনেক দিন বকেয়া রয়েছে। তাই তাঁরা বিক্ষোভ দেখান।” তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য দাবি করেন, “এ দিন কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিকই রয়েছে।”
শুক্রবার রানিগঞ্জের জে কে নগরে ইসিএলের কোলিয়ারির পিট ম্যানেজারকে মারধরের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে নাম উঠে এসেছেআইএনটিটিইউসি নেতা চুনুলাল মিশ্রের। তার পরেও কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হল না, তা নিয়ে এ দিন ক্ষোভ ছড়ায় ইসিএল কর্তাদের মধ্যে। চুনুলালকে গ্রেফতারের দাবিতে এ দিন সকালে জে কে নগর কোলিয়ারিতে বিক্ষোভ দেখান অফিসারেরা। ইসিএল কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা লিখিত অভিযোগও জানান। বিক্ষোভরত অফিসারেরা অভিযোগ করেন, ইসিএল তাদের কর্মী চুনুলাল মিশ্রকে সাসপেন্ড করলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতারে উদ্যোগী হচ্ছে না। ইসিএলের অফিসারেরা জানিয়েছেন, চুনুলালকে না ধরলে ওই কোলিয়ারিতে তাঁরা কাজ বন্ধ করে দেবেন। পুলিশ অবশ্য যথারীতি জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত চলছে।
আবার এ দিনই হাওড়ার বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কারখানায় কর্মচ্যুত হয়েছেন ১৪০ জন ঠিকা শ্রমিক। শুক্রবার তাঁদের বসিয়ে দেওয়ার পর এ দিন সকাল থেকে কাজের দাবিতে তৃণমূলের শ্রমিক ইউনিয়ন আইএনটিটিইউসি-র পতাকা নিয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ দেখান শ্রমিকরা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কারখানার মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বার্ন স্ট্যার্ন্ডাড কর্তৃপক্ষের তরফে আবশ্য জানানো হয়, গোলমাল বড় আকার নেয়নি বা কারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হয়নি।
এটা এক দিনের ছবি। চলতি সপ্তাহেই রাজ্যের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী কারখানা শতাব্দীপ্রাচীন শালিমার পেন্টস-এ তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। এই নিয়ে সরকার মালিক পক্ষের সঙ্গে নিয়মমাফিক বৈঠক করলেও কারখানা খোলার আশা কেউ করছেন না। যদিও কারখানার গেটে অবস্থান করছেন কর্মহীন শ্রমিকরা। তার পরেই জামুড়িয়ার শ্যাম সেল কারখানায় শাসক দলের তোলাবাজির অভিযোগ, যাকে এ দিন ‘ছোট ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ রাজ্যে সরকার বদলের পর শিল্পমহল আশা করেছিল, বাম আমলের স্থবিরতা কাটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলবেন। তিন বছর বাদে সেই আশা ক্রমশ হতাশার চেহারা নিয়েছে। অনেকে বলছেন, শিল্প ক্ষেত্রে সেই আশির দশকের ছায়াই দেখা যাচ্ছে, যেখানে কারখানা-চটকল-চা বাগান সর্বত্র এক অনিশ্চয়তার ছায়া।