সেই ভুয়ো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ।ছবি:সুদীপ্ত ভৌমিক
মোবাইল স্ক্রিনে ফুটছে স্থানীয় নম্বর, কিন্তু ফোন আসছে বিদেশ থেকে। অভিযোগ গিয়েছিল টেলিকম দফতরে। তদন্তে নেমে সাধারণ যন্ত্রপাতি নয়, হুগলির রিষড়ায় দু’টি বেআইনি টেলিফোন এক্সচেঞ্জের হদিস পেলেন গোয়েন্দারা। জোড়া এক্সচেঞ্জের মালিক ও তাঁর ছেলেকে ধরা হয়েছে। এলাকায় তাঁরা প্রোমোটারি কারবারের সঙ্গে যুক্ত বলে পরিচিত। তবে সিআইডি ও টেলিকম দফতরের ‘টেলিকম এনফোর্সমেন্ট রিসোর্স অ্যান্ড মনিটরিং’ (টার্ম) সেল-এর ধারণা, এই বেআইনি কারবারের পিছনে টেলিকম এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা আছে।
ভিতরে যে বেআইনি এক্সচেঞ্জ চলছে, ঘুনাক্ষরেও দেখে বোঝার উপায় ছিল না। রিষড়া বাজারে নেতাজি সুভাষ রোডে একটা বাড়ির চারতলায় বন্ধ ঘরের দরজা খুলেই অবাক অফিসারেরা। ভিতরে রীতিমতো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ! ছাদের উপরে বিশালাকার বিটিএস (বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন) যন্ত্র। সেখান থেকে তার এসে ঢুকেছে ঘর লাগোয়া বারান্দায়। সেখানে অসংখ্য তারের জড়াজড়ি। বারান্দায় খোপ করে রাখা অনেক যন্ত্র। সেখানে মোবাইলের সিম ঢোকানো। লাল বাতিগুলি জ্বলছে। রাউটার, মোডেম, সিম বা চ্যানেল ব্যাঙ্ক — কী নেই!
ঘরে কেউ নেই, অথচ, যন্ত্র চলছে ২৪ ঘণ্টা, ৩৬৫ দিন। উল্টো দিকের ঘরে সংসার প্রকাশ শর্মার। তিনি বলেন, ‘‘ওই ঘর তো বন্ধই পড়ে থাকে। কালেভদ্রে তিলক কাটা ২২-২৩ বছরের একটি ছেলেকে দেখি আসতে। ১৫-২০ মিনিট থেকে চলে যায়। বাকি সময়ে ঘরটা বন্ধই থাকে।’’
কাছাকাছি আর একটি বাড়িতেও বেআইনি টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সন্ধান পেয়েছে টার্ম সেল এবং সিআইডি। অভিযোগ, দু’টি এক্সচেঞ্জই চালাচ্ছিলেন রমেশ সাউ। তাঁকে এবং তাঁর ছেলে রতনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। ধৃতেরা রিষড়ার এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার আত্মীয়।
টার্ম সেল-এর ডিরেক্টর অরূপ দাস এবং ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল অতনু ঘোষ ছিলেন ওই অভিযানে। অতনুবাবুর কথায়, ‘‘যে ভাবে এক্সচেঞ্জ বানানো হয়েছে, মনে হচ্ছে, টেলিকম ও আইটি-র বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।’’
মাস তিনেক আগে টেলিকম দফতর যখন তদন্তে নামে, তখন জানা গিয়েছিল বালাজি ইন্টারন্যাশনাল’ নামে এক সংস্থার নামে তোলা সিমকার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে কোনও বেআইনি এক্সচেঞ্জে। ওই সংস্থার সূত্রে মেলে রমেশ সাউয়ের সন্ধান। এ দিন উদ্ধার হওয়া সব যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
কী ভাবে চালানো হত ওই এক্সচেঞ্জ? অরূপবাবু বলেন, ‘‘বিদেশ থেকে কলিং কার্ড মারফত যে ফোন এ দেশে আসছে, তার বেশ কিছু কল বেআইনি ভাবে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছিল এই এক্সচেঞ্জে। বেশ কিছু সংস্থার মোবাইল সিম কার্ড ব্যবহার করছিলেন এই এক্সচেঞ্জ চালানো ব্যক্তি। ওই বিদেশি কলগুলি যখন আমার-আপনার মোবাইলে যাচ্ছিল, তখন আমাদের মোবাইলে ফুটে উঠছিল স্থানীয় নম্বর। অথচ, ফোন আসছিল বিদেশ থেকে।’’
তাতে অসুবিধা কোথায়? অরূপবাবু জানান, প্রথম সমস্যা নিরাপত্তার। তাঁর কথায়, ‘‘বিদেশ থেকে কেউ ফোন করার সময়ে আপনার মোবাইলে যদি স্থানীয় নম্বর ফুটে ওঠে, তা হলে বিদেশ থেকে কে ফোন করেছিলেন, অতি বড় প্রয়োজনেও তদন্তকারী সংস্থা তা জানতে পারবে না।’’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত সিআইডি অফিসারদের আশঙ্কা, আইএস-এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠী এ ধরনের বেআইনি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমেই এ দেশে তাদের নানা সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
আরও একটি দিক নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে বলে জানান তদন্তকারীরা। তাঁদের বক্তব্য, নিয়ম মতো বিদেশি মোবাইল থেকে ফোন এলে ভারতীয় কোনও মোবাইল সংস্থার ‘গেটওয়ে’ ব্যবহার করে তবেই তা নির্দিষ্ট ব্যক্তির মোবাইলে পৌঁছয়। এ জন্য বিদেশি মোবাইল সংস্থা সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সংস্থাকে মিনিটে ৫৬ পয়সা হিসেবে ভাড়াও দেয়। তার একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের ঘরে কর হিসেবে ঢোকে। অরূপবাবুর কথায়, ‘‘এখন বোঝাই যাচ্ছে, কিছু সংস্থা ওই টাকা দেবে না বলে ভারতে এ রকম বেআইনি এক্সচেঞ্জ ব্যবহার করছে। সে ক্ষেত্রে মিনিটে ৫৬ পয়সা পরিবর্তে হয়তো ৩০ পয়সা দিচ্ছে। বছরের হিসেবে অঙ্কটা বিশাল। কারণ, রিষড়ার এই বেআইনি এক্সচেঞ্জে ১৭০টি স্থানীয় সিম ব্যবহার করে প্রতি ঘণ্টায় ৬ লক্ষ সেকেন্ড কল হচ্ছে।’’
গোয়েন্দাদের দাবি, এই বেআইনি এক্সচেঞ্জ চালিয়ে বিদেশ থেকে প্রভূত টাকা রোজগার করছিলেন রমেশ সাউ। কিন্তু কী ভাবে সে টাকা তিনি পেতেন তা জানতে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করা হবে।