ইরাকে নিহত নদিয়ার দুই বাসিন্দা খোকন সিকদার এবং সমর টিকাদার। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক
এতগুলো বছর একটা আশা আঁকড়ে ধরে বেঁচেছেন —‘হয়তো সে ফিরবে এক দিন’। মঙ্গলবার রাতে দিল্লি থেকে ফোন আসার পর বেঁচে থাকার সেই সম্বলটুকু মুছে গিয়েছে। দীপালি টিকাদারকে জীবন এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সত্যের সামনে। জানিয়ে দিয়েছে, এ বার মানসিক ভাবেও তিনি একা। দু’টি সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব একাই নিতে হবে। আর কোনওদিনই পাশে এসে দাঁড়াবেন না স্বামী সমর টিকাদার। এত দিনে সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, তিনি মৃত!
বছর চারেক আগে শেষ বারের মতো কর্মক্ষেত্র ইরাকে ফিরে যান সমর। তার পর থেকে অপেক্ষা শুরু হয়েছিল দীপালির। একটা সময় ফোন আসা বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনের সমস্ত স্তরে শুধু ছুটে বেরিয়েছেন দীপালি, স্বামীর একটা খবর পাওয়ার জন্য। মঙ্গলবারের পরে একটা রাগ ধাক্কা মারছে তাঁর চেতনায়। একটা মানুষ যে নেই সেটা জানাতে সাড়ে তিন বছর সময় নেয় দেশের সরকার! মানুষের জীবন কি এতটাই খোলামখুচি!
স্বামী ইরাকে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন বাপের বাড়ি হাঁসখালির হলদিপাড়ায়। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে চাকরি টিকিয়ে রাখতে প্রতিদিন ভীমপুর থানা-র মহখোলা থেকে কাঁদিপুর বর্ডার রোড ধরে ২০ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেছেন দীপালি। গত কয়েক দিন ধরে একটি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যারাকপুরে রয়েছেন। সেখানেই স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে দাঁতে-দাঁত চেপে চুপ করে ছিলেন। কাউকে কিচ্ছু জানাননি, কাঁদেননি। সেই অবস্থায় বুধবার সকালে প্রশিক্ষণেও গিয়েছেন। সন্ধ্যায় ফিরে এসে ছেলে সুদীপ্তর ফোন পাওয়ার পরে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়। দশম শ্রেণির ছাত্র মা-কে সান্ত্বনা দিয়েছে—‘‘দুঃখ কোরো না মা, আমি তো আছি।’’ মেয়ে শর্মিষ্ঠার বয়স ৮ বছর। বাবাকে মনে পড়ে না তার। কিন্তু সুদীপ্তর স্মৃতিতে ফিরে আসে বাবা—‘‘মামার বাড়ি থেকে বাবা সাইকেলে চাপিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেত। পথে কত রকম গল্প করত।” ২০১৩ সালে বিমানবন্দরে শেষ বারের মতো বাবাকে সে দেখেছিল। “বাবা বলেছিল, আমি যেন ভাল করে পড়াশোনা করি। ওটাই শেষ কথা।’’
মঙ্গলবার খোকন সিকদারের মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছোনোর পর থেকে আত্মীয়-পড়শির ভিড় কমছে না তেহট্টের ইলশেমারি গ্রামে সিকদার বাড়িতে। বাড়িতে স্ত্রী নমিতা, নয় বছরের ছেলে অভ্র ও বছর উনিশের মেয়ে রিতা। বুধবার তাঁদের বাড়ি যান বিজেপির জেলা সভাপতি মহাদেব সরকার, পলাশিপাড়ার বিধায়ক তৃণমূলের তাপস সাহা ও তেহট্টের বিধায়ক গৌরীশঙ্কর দত্ত। গৌরীশঙ্কর দত্ত জানিয়েছেন, নমিতা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকার কাজ করেন। তার মেয়ে রিতা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদে তাঁর কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এপ্রিল মাস থেকে তিনি কাজে যোগ দেবেন। খোকনের মা নব্বই বছরের শোভা দেবী অসুস্থ। ছেলের মৃত্যুর খবর তাকে এখনও দেওয়া হয়নি।