ভাঙন ঠেকাতে তিস্তা চরে বাঁধ

চাষের জমি রক্ষার জন্য তিস্তা নদী চরে এবার বাঁধ নির্মাণ করবে সেচ দফতর। সেই সঙ্গে চর এলাকার উপর দিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার রাস্তার ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রবিবার ময়নাগুড়ি, রাজগঞ্জ ব্লক এবং মালবাজার মহকুমার প্লাবিত নদী চর এলাকা ঘুরে দেখে ওই আশ্বাস দেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য ও সব্যসাচী ঘোষ

জলপাইগুড়ি ও মালবাজার শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৫ ০২:২১
Share:

শ্বেতীঝোরা দিয়ে শুরু হল যান চলাচল। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

চাষের জমি রক্ষার জন্য তিস্তা নদী চরে এবার বাঁধ নির্মাণ করবে সেচ দফতর। সেই সঙ্গে চর এলাকার উপর দিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার রাস্তার ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রবিবার ময়নাগুড়ি, রাজগঞ্জ ব্লক এবং মালবাজার মহকুমার প্লাবিত নদী চর এলাকা ঘুরে দেখে ওই আশ্বাস দেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “মানবিক কারণে ওই কাজ করতে হচ্ছে। চর এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করে। তাঁরা নিঃস্ব হয়েছেন।”

Advertisement

ইতিমধ্যে চর এলাকায় বসতি নিয়ে পরিবেশপ্রেমী-সহ বিভিন্ন মহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। নদী রক্ষার দাবিতে সরব হয়েছেন গবেষক মহল। এবার তিস্তায় বন্যা হয়নি। নদী তার নিজের এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলেও তাঁরা দাবি করেন। সেচমন্ত্রী নিজেও বলেন, “বন্যা হয়েছে এটা বলছি না।” বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে তবে কেন চর এলাকার জবর দখল রক্ষার চেষ্টা? মন্ত্রীর সাফাই, “বাম জমানায় চরে লোকজন বসানো হয়। সেই পাপ বহন করতে হচ্ছে।” রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে কি বামেদের পথে নদী চরে বাঁধ দেওয়ার উদ্যোগ? প্রশ্ন এড়িয়ে মন্ত্রী হেসে বলেন, “এখন বিতর্কের সময় নয়। মানবিক দিক থেকে বিচার করে কাজ করতে হচ্ছে।”

নদী গবেষক তথা ময়নাগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রধান মধুসূদন কর্মকার অবশ্য মন্ত্রীর বক্তব্য শুনে অবাক। তিনি বলেন, “চর এলাকায় বসতি গড়ে তোলার অর্থ নদীর গতিপথ অবরুদ্ধ করা। সেটা মোটেও কাম্য নয়।”

Advertisement

জলপাইগুড়ি টাকিমারি চর এলাকায় ত্রাণশিবিরে বানভাসিরা। ছবি: সন্দীপ পাল।

এদিন দুপুর নাগাদ সেচমন্ত্রী রাজগঞ্জের টাকিমারি চর এলাকায় যান। সেখান থেকে বিকালে গজলডোবা হয়ে মালবাজার মহকুমার বাসুসুবা এলাকায় পৌঁছে যান। দুপুর থেকে চাঁপাডাঙা এলাকার তৃণমূল সমর্থকরা হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে মঞ্চ গড়ে সেখানে নদী চরে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানাতে থাকেন। দাবির কথা শুনে মন্ত্রী তাঁর আধিকারিকদের কাছে জানতে চান কোথায় বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান গৌতম দত্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছয় নম্বর স্পার লাগোয়া উড়ে যাওয়া কৃষি দফতরের মাটি সংরক্ষণ বিভাগের তৈরি বাঁধের অংশবিশেষ দেখান। মন্ত্রী জানতে চান ওই বাঁধ তৈরি করা হলে কী উপকার হবে? জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী জানান, ওই বাঁধ তৈরির পরে এখানে কৃষি কাজ শুরু হয়। বসতিও সুরক্ষিত ছিল। গত বৃহস্পতিবার বাঁধ ভেঙে হু হু করে বসতি এলাকায় জল ঢুকেছে। পাকা রাস্তার সেতুর তলা গিয়ে পলি ভরা ঘোলা জল ছড়িয়ে পড়ছে মাস্টার পাড়া, কেরানি পাড়া, ঠাকুরদাস পাড়ায়। অন্তত তিনশো পরিবার সেখানে জলবন্দি হয়েছে। পনেরোটি পরিবার সেচ দফতরের উঁচু বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

বাসুসুবা এলাকা থেকে বিকাল পাঁচটা নাগাদ মন্ত্রী যান ময়নাগুড়ি ব্লকের বর্মনপাড়ায়। স্থানীয় বাসিন্দারা মন্ত্রীকে জানান, ১৯৮৫ সালে চাষের জমি ও বসতি এলাকা রক্ষার জন্য সেচ দফতরের উঁচু বাঁধ থেকে আধ কিলোমিটার দূরে কৃষি দফতর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করে। বাসুসুবা সেন পাড়া এলাকা থেকে বর্মন পাড়া পর্যন্ত ওই বাঁধ বিস্তৃত। বৃহস্পতিবার বাঁধের বিরাট অংশ উড়ে অন্তত ছয় হাজার মানুষ বিপন্ন হয়েছেন। মন্ত্রী সেচ আধিকারিকদের ডেকে জানান, কার বাঁধ, কে তৈরি করেছিল এসব এখন ভেবে লাভ নেই। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। পরে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে জল থাকায় বাঁধের সবটা তৈরি করা যাবে না। তবে সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।” সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গজলডোবা থেকে গৌরীকোন এবং বাসুসুবা থেকে বর্মনপাড়া পর্যন্ত কৃষি দফতরের মাটি সংরক্ষণ বিভাগের ভেঙে যাওয়া পুরনো বাঁধ মেরামত করা হবে। যে সমস্ত জায়গায় বাঁধ উড়ে গিয়েছে সেখানে নতুন করে বাঁধ হবে।

তিস্তার বাঁধ পরিদর্শনে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার ময়নাগুড়ির দোমহনির বর্মণপাড়ায়। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

অন্যদিকে, তিস্তার অসংরক্ষিত এলাকায় ফি বছরেই জল বাড়লেই নদীর জল গ্রাম ভাসিয়ে দিচ্ছে। এদিন সেচমন্ত্রীকে হাতের কাছে পেয়ে তাই ত্রাণ নয় বাঁধের দাবিই করলেন বাসিন্দারা। তিস্তার ডান তীরে থাকা মান্তাদাড়ি এবং বারোপেটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে বন্যার্তদের ত্রাণশিবির পরিদর্শন করতে আসেন সেচমন্ত্রী। ঘুরেফিরে এলাকাবাসীরা প্রত্যেকেই সেচমন্ত্রীকে তিস্তায় মজবুত বাঁধ তৈরির কথাই বলেন। এলাকার বাসিন্দা তপন মণ্ডল, শৈবাল ভৌমিকেরা বলেন, ‘‘সেচমন্ত্রীকে আমরা সকলেই তিস্তায় বাঁধ না থাকাটাই যে মূল সমস্যা সেটা জানিয়েছি। সেচমন্ত্রীও বাঁধ তৈরির বিষয়ে সদর্থক ইঙ্গিত দেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘‘তিস্তায় বাঁধ তৈরি করে বন্যা রোধ করতে আমরাও চাই। তিস্তা ব্যারাজের পর তিস্তায় ১৩ থেকে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরির প্রস্তাব আমি পেয়েছি।’’ এদিকে ত্রাণ শিবিরে থাকতে ক্লান্ত বাসিন্দারা। রুমা দাস, স্মৃতি দাসেরা টাকিমারি এলাকার উচ্চবিদ্যালয়ের দশম ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ওদের কথায়, ‘‘ত্রাণ শিবিরে কোনমতে আমরা রয়েছি। স্কুলে গেলেও পড়াশোনা হচ্ছে না।’’

এরই মধ্যে বৈকুণ্ঠপুর বনবিভাগের বেলাকোবা রেঞ্জের জঙ্গল থেকে মাঝেমধ্যেই চলছে দাঁতালের হানাদারি। শনিবার রাতে দাঁতালের পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন আনন্দি তালুকদার নামের এক বৃদ্ধাও। আর আছে সাপের উপদ্রব।

এদিন এলাকা পরিদর্শন করে সেচমন্ত্রী গজলডোবা তিস্তা ব্যারাজের হাওয়ামহলে সেচকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী। সৌরভ বলেন, ‘‘নদীর জল নেমে না যাওয়া পর্যন্ত ত্রাণ শিবিরগুলি চলবে।’’ গজলডোবায় বৈঠক করে মন্ত্রী দোমহনী পরিদর্শনে চলে যান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন