কন্যাশ্রীর টাকায় বিয়ের পণ

ভাতিণ্ডা হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিল রাজিয়া (নাম পরিবর্তিত)। গত অগস্টে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কন্যাশ্রী-টু প্রকল্পের এককালীন অনুদান ২৫ হাজার টাকা ঢোকে। সেই মাসেই রাজিয়ার পরিবার তার বিয়ে দেয়। রাজিয়া জানিয়েছে, কন্যাশ্রী থেকে পাওয়া অর্থের ২০ হাজার টাকা পাত্রকে পণ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ০৩:৪৭
Share:

ভাতিণ্ডা হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিল রাজিয়া (নাম পরিবর্তিত)। গত অগস্টে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কন্যাশ্রী-টু প্রকল্পের এককালীন অনুদান ২৫ হাজার টাকা ঢোকে। সেই মাসেই রাজিয়ার পরিবার তার বিয়ে দেয়। রাজিয়া জানিয়েছে, কন্যাশ্রী থেকে পাওয়া অর্থের ২০ হাজার টাকা পাত্রকে পণ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।

Advertisement

রাজারহাট যাত্রাগাছির রেজিনা খাতুনের (নাম পরিবর্তিত) একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়েই আঠেরো বছর হয়ে গিয়েছিল। কন্যাশ্রীর পঁচিশ হাজার টাকা পেয়ে যায় সে-ও। তার পরই তার বিয়ে হয়ে যায় ভাঙড়ে। অভিযোগ, সেখানেও অনুদানের টাকায় পণ দেওয়া হয়েছিল।

রাজারহাটেরই ঘুনি গ্রামের মেয়ে সাবিনা (নাম পরিবর্তিত) উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ডিরোজিও কলেজে স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়েছিল। ততক্ষণে তার অ্যাকাউন্টেও টাকা এসে গিয়েছে। আচমকা সেপ্টেম্বর মাসে বসিরহাটে তার বিয়ে হয়ে যায়। সরকারি অনুদানের টাকায় পাত্রের জন্য মোটরবাইক কিনে দিতে হয়েছে সাবিনার পরিবারকে।

Advertisement

বাল্যবিবাহ আটকানো এবং মেয়েদের পড়াশোনা শিখিয়ে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প চালু করেছেন। কিন্তু পড়াশোনার পরিবর্তে কন্যাশ্রীর টাকায় বরপণ দেওয়ার ঘটনা মুখ্যমন্ত্রীর সাধের প্রকল্পে নজরদারির অভাবকেই প্রকট করছে বলে অভিযোগ। নবান্ন সূত্রের খবর, কন্যাশ্রী প্রকল্পে দু’টি ধাপ। প্রথম ধাপে টাকা মেলে অষ্টম শ্রেণি থেকে। বছরে ৭৫০ টাকা। দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ কন্যাশ্রী-টু’তে মেয়েদের আঠেরো বছর বয়স হলে সরকার এককালীন ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়।

সেই টাকা বিয়েতে খরচ হওয়া কি বাঞ্ছনীয়? নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের শীর্ষকর্তাদের দাবি, সরাসরি আপত্তি তোলার জায়গা নেই। কারণ, ২৫ হাজার টাকা হাতে পেলে মেয়েটির পরিবার সেই অর্থ দিয়ে কী করবে— তা সরকারি নির্দেশিকায় স্পষ্ট করে বলা নেই। তা ছাড়া ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলে বিয়ে আইনসিদ্ধও বটে।

দফতরের সচিব রোশনি সেনের কথায়, ‘‘২০১৩ সালে কন্যাশ্রী প্রকল্প করার সময় আমাদের লক্ষ্য ছিল, এ রাজ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমানো। কন্যাশ্রী টু’র অনুদান পেতে গেলে শুধু ১৮ বছর বয়স হলেই চলবে না। তাকে কোনও স্কুল বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হতে হয়। কিন্তু ওই টাকা কী ভাবে খরচ হবে, তা নিয়ে শর্ত চাপানো হয়নি।’’ তবে রোশনি এ কথাও বলছেন যে, ‘‘টাকাটা যাতে নিজেদের স্বনির্ভর করার কাজেই ব্যয় করে মেয়েরা, তার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছি আমরা। বছরভর সচেতনতা শিবিরও চলছে জেলায় জেলায়।’’

কিন্তু তাই বলে কন্যাশ্রীর টাকায় পণ? সচিবের মতে, ‘‘এমন অভিযোগ হাতে আসেনি। এমনটা হলে তা আইনবিরুদ্ধ।’’ সচিবের হাতে অভিযোগ জমা না পড়লেও উত্তর ২৪ পরগনার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। তাদের দাবি, জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে তাঁরা এমন ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। এ নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে মণিশঙ্করবাবু ফোন কেটে দেন।

একই ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকেও। পিয়ালির বাসিন্দা চম্পাহাটি গার্লস হাইস্কুলের পারমিতা মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) ২০১৫ সালে এককালীন টাকা পেলে সেই টাকা বিয়েতে খরচ হয়। রয়েছে ক্যানিংয়ের দ্বারিকানাথ হাইস্কুলের পিঙ্কি পুরকাইত (নাম পরিবর্তিত) এবং আয়ুবনগরের সর্বাণী বসুর (নাম পরিবর্তিত) উদাহরণও। সব ক্ষেত্রেই বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে মেয়েরা। রাজারহাটের রাজিয়া পড়াশোনা চালাতে চেয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি রাজি হয়নি। সমাজকল্যাণ দফতরেরই আশঙ্কা, এ রকম ঘটনা সম্ভবত রাজ্য জুড়েই ঘটছে।

জেলাস্তরের আধিকারিকদের ব্যাখ্যা, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে সব মেয়েরা স্কুল যাওয়া বন্ধ করেছে, কন্যাশ্রী-টু তাদের আবার স্কুলে টেনে এনেছে। প্রথমে সেটা ভাল বলে মনে করা হলেও, পরে দেখা যাচ্ছে, কন্যাশ্রী-টু’র টাকা পাওয়ার পর পরিবারগুলি মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলছে। এই আধিকারিকদের বড় অংশই কন্যাশ্রীর টাকায় বিয়ে বা পণ দেওয়া নিয়ে খুব বিস্মিত নন। তাঁদের মতে, এ হল গোড়ায় গলদ। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ গরিব পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে পণ দেওয়াটা এখনও প্রায় বাধ্যতামূলক। এই অবস্থায় কোনও পরিবারের হাতে এক লপ্তে ২৫ হাজার টাকা এলে তা পণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে— এটা অস্বাভাবিক নয়। আধিকারিকদের মতে, উদ্দেশ্য যেখানে পড়াশোনা শিখিয়ে স্বাবলম্বী করা, সেখানে উপযুক্ত নজরদারির ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। এককালীন বড় অঙ্কের টাকা না-দিয়ে স্নাতক স্তরে তিন বছরের জন্য তিনটি ভাগে টাকা দিলে ভাল হতো। নারী আন্দোলন-কর্মী শাশ্বতী ঘোষও ‘কন্যাশ্রী’র সদর্থক ভূমিকা অস্বীকার না করেও বললেন, ‘‘বিবাহিত মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে অবিবাহিত বলে লিখিয়ে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।’’ তাঁর পরামর্শ, একসঙ্গে এত টাকা না দিয়ে সরকার অন্য ভাবে বিষয়টা ভাবতে পারে।

ফের ক্ষমতায় এলে ‘কন্যাশ্রী প্লাস’ নামে তৃতীয় ধাপ চালু করার পরিকল্পনা আছে মুখ্যমন্ত্রীর। সমাজকর্মীদের আশঙ্কা, উদ্দেশ্য সাধু হলেও প্রয়োগের দিকে নজর না দিলে হিতে-বিপরীত হতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement