রাজ্যকে পরামর্শের কথা কবুল

অনুশাসন নেই, তাই আচরণবিধি: কেশরী

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন ও সমালোচনা তীব্র হচ্ছে। তার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষাকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট আচরণবিধির পক্ষে ফের সওয়াল করলেন খোদ আচার্য-রা়জ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৪:১৪
Share:

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন ও সমালোচনা তীব্র হচ্ছে। তার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষাকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট আচরণবিধির পক্ষে ফের সওয়াল করলেন খোদ আচার্য-রা়জ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী।

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মীদের মাইনে সরকারই দেয়। তাতেই সেখানকার কাজকর্মে সরকারের নাক গলানোর অধিকার জন্মায় বলে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইদানীং বারে বারে এক্তিয়ার জাহির করে চলেছেন। সাম্প্রতিক কালে কলকাতা থেকে যাদবপুর— বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে যখনই সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে, এই সওয়াল করেছেন তিনি। তারই জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আচরণবিধি তৈরি করে দেওয়ার কথা তোলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি জানিয়েছিলেন, রাজ্যপালের সুপারিশেই রাজ্য সরকার আচরণবিধি তৈরি করবে। তার জন্য উপাচার্যদের নিয়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

খোদ শিক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে রাজ্যপালের ওই সুপারিশের কথা শুনে প্রশ্ন উঠেছিল, আচরণবিধি বেঁধে দেওয়ার এই উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে হস্তক্ষেপ নয় কি? বিতর্কের মুখে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন, আচার্য-রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলেই পরবর্তী পদক্ষেপ করবে রাজ্য সরকার। রাজ্যপাল বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগকেই সমর্থন করেছেন। তিনি এ দিন কলকাতায় বলেন, ‘‘আমি রাজ্য সরকারকে এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি। বিষয়টি বিবেচনা করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারেরই।’’

Advertisement

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই আলাদা ‘স্ট্যাটিউট’ বা বিধি রয়েছে। তাতে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষাকর্মীদের কার কী কর্তব্য, তা নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া আছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে আচরণবিধি তৈরির প্রয়োজন হচ্ছে কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে। কেন আবার আচরণবিধি দরকার, শিক্ষাঙ্গনের সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উল্লেখ করে রাজ্যপাল এ দিন ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনুশাসনহীনতা চলছে।’’

আচার্যের এই ব্যাখ্যায় প্রশ্নের নিরসন হওয়া তো দূরের কথা, নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, নিজস্ব বিধি থাকা সত্ত্বেও সরকারের তরফে বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়া আচরণবিধি চাপিয়ে দেওয়াটা কি স্বশাসনে নাক গলানোর চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত নয়? আচার্য হয়ে রাজ্যপাল কী ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে সরকারি হস্তক্ষেপ সমর্থন করেন? সরকারকে তিনি এই ধরনের আচরণবিধি তৈরির কোনও পরামর্শ দিতে পারেন কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠছে রাজ্যপালের এক্তিয়ার নিয়েও।

‘‘সরকারকে এমন কিছু করতে বলার এক্তিয়ার নেই আচার্যের। আচার্য নিজেই নিজের এক্তিয়ার সম্পর্কে সচেতন নন,’’ মন্তব্য করেছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। আচরণবিধি তৈরিতে সরকারের আদৌ কোনও ভূমিকা থাকতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসুও। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মালবিকা সরকারের মতে, আচরণবিধি নিয়ে কিছু বক্তব্য থাকলে আচার্যের তরফে সরকার নয়, উপাচার্যকেই তা বলার কথা। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র আলাদা। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব কিছু বিধি থাকে। সেই জন্য আচরণবিধি নিয়ে উপাচার্যদের সঙ্গে সরাসরি আচার্যের কথা বলাই ভাল।’’

এই মুহূর্তে রাজ্যের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশাসন নেই বলে রাজ্যপাল যে-মন্তব্য করেছেন, তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ। তিনি বলেন, ‘‘দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা নিয়ে আচার্যের দুশ্চিন্তা প্রকাশ একটা ভাল ইঙ্গিত।’’ যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরের আচরণবিধির সুপারিশ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ক্যাম্পাসের ভিতরে আমাদের কার কী দায়িত্ব, আমরা সকলেই তা জানি। আচার্যকে অনুরোধ, সরকারকে পরামর্শ যদি দিতেই হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করার আদর্শ পরিবেশ গড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিন।’’

আচার্যের বক্তব্যের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন শাসক দল তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা-র রাজ্য সভানেত্রী কৃষ্ণকলি বসু। তিনি বলেন, ‘‘আচার্যই তো এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অধিকারী। তিনি যদি মনে করে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশাসনবিধি তৈরি করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে, তা হলে সরকারের উচিত আচার্যের প্রস্তাবকে মান্যতা দেওয়া।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে মঙ্গলবারেই ফের সরব হয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। প্রশাসনিক বিষয় এবং পঠনপাঠন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সব বিষয়েই সরকারি হস্তক্ষেপের পূর্ণ স্বাধীনতার বিষয়টি কার্যত স্পষ্টই করে দিয়েছিলেন পার্থবাবু। রাজ্যপালের এ দিনের বক্তব্য স্বশাসনের বাকি দুই ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতেও সরকারকে ইন্ধন জোগাবে বলে শিক্ষামহলের আশঙ্কা। খোদ আচার্যই সেই পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন বলে মনে করছেন আবুটা-র সভাপতি তরুণ নস্কর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতেই যে আচরণবিধি দেওয়া রয়েছে, তা স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘‘যদি আচার্যের মনে হয় যে, এই আচরণবিধি অপ্রতুল, তা হলে নয়া বিধি তৈরির জন্য তাঁর উপাচার্যদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। রাজ্য সরকারের সঙ্গে মোটেই নয়। শিক্ষামন্ত্রী যদি উপাচার্যদের আচরণবিধি তৈরি করতে বলেন, তা হলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন ফের বিপন্ন হয়ে পড়বে।’’

কী বলছেন শিক্ষামন্ত্রী?

স্বাধিকারের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে পার্থবাবু এ দিন বলেন, ‘‘আচার্য-রাজ্যপালের প্রস্তাব নিয়ে ঠিক সময়েই পদক্ষেপ করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন